পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ী নারী ও মাসিক ব্যবস্থাপনা

Published: 27 May 2020   Wednesday   

 

আপ্রুমা মারমা, বয়স ১২ বছর। আপ্রুমা পার্বত্য অঞ্চলের একটি দুর্গম এলাকায় বসবাস করে তার পরিবারের সাথে। তার প্রথম যেদিন মাসিক হয় সে খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ও মনে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন আসতে থাকে। কিন্তু অজানা ভয় আর লজ্জায় সে বিষয়টি কাউকে বলতে পারে না। মাসিক শুরু হলে সে এটিকে কেমনে সামলাবে বুঝতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়ে। সে ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয় । এমনকি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সামনে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তার এমন লুকোচুরি আচরণের তার মা-র চোখে পড়ে ও তাকে জিজ্ঞেস করে “কীরে মা তোর কী হয়েছে, তুই কেন এমন করতাছ । সে অজানা ভয়ে মাকেও এড়িয়ে যায়, নিশ্চুপ থাকে।

 

এক পর্যায়ে আপ্রুমা তার মাসিকের কথা তার মা-কে জানায় এবং স্বস্তির নি:শ্বাস ছাড়ে। মা তাকে বলে, সে সাবালক হয়েছে। এসময় ছেলেদের সাথে মেলামেশা করা যাবে না সে গর্ভবতী হয়ে যেতে পারে। সে মাকে মাসিকের সাথে পেট ব্যাথার কথা জানালে তার মা জানালো বিয়ের পর এটি আপনা আপনি ঠিক হয়ের্ যাবে। তার মা আরো জানালো লাফালাফি করা যাবে না, স্কুলে গেলে পেছনে বসতেহবে, টক জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না, খেলে রক্ত বেশি যাবেই। তার মাতাকে এও বলে, এই বিষয়টি সে যাতে কারো সাথে আলোচনা না করে এবং সে যাতে একটি জায়গায় চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তু তার মায়ের সাথে কথা শুনে সে আরো বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তার মায়ের দেওয়া তথ্য পেয়ে তার মনে এই ধারণা তৈরি হয় যে, মাসিক একটি অসুখ। এতে সে মানসিকভাবে আরো দুর্বল করে পড়ে এবং এর পাশাপাশি তার শারীরিক সমস্যারও দেয় দেখা । এমনিভাবে তার দিন কাটতে থাকে আতঙ্ক, ভয়, দ্বিধা আর ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে।

 

আপ্রুমার মত হাজার হাজার কিশোরীর মনে বিরাজ করছে নানা প্রশ্ন, শংকা ভয় ও আতঙ্ক। বাংলাদেশের সকল জাযগায় এটি একটি চিরাচরিত চিত্র হলেও তিন পার্বত্য জেলায় এই চিত্রটি আরো করুণ। মাসিক সংশ্লিষ্ট এসব শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সাথে এই অঞ্চলে যুক্ত হয়েছে ভৌগোলিক অবস্থা, অপ্রতুল স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতা, সামাজিক প্রথা, পাহাড়ীদের প্রথাগত ব্যবস্থা, জীবনযাত্রার মান এবং অর্থনৈতিক অবস্থা। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্গম অঞ্চল হওয়ার কারণে এখানে বসবাসকারী ১৩ ভাষাভাষীর পাহাড়ীরা বিভিন্ন মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত।


বিভিন্ন পাহাড়ী সমাজের সামাজিক কাঠামো, প্রথাগত আইন সামাজিক রীতিনীতি,নিরক্ষতা,অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস এবং সামাজিক সংস্কার ইত্যাদির প্রভাবে নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে, বঞ্চিত হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায়। অনুন্নত যোগাযোগ, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে তাদের মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে কেনো ধারণাই নেই, এমনকি পাহাড়ী অধিকাংশ নারীই জানেন না মাসিক ব্যবস্থাপনা প্রজনন স্বাস্থ্যেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দুর্গম  এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক দূরে দূরে থাকায় পাহাড়ী নারী ও কিশোরীরা লেখাপড়ার সুযোগ কম। ফলে গতানুগতিক প্রথাগত ব্যবস্থায় নিজের অধিকার, শরীর ও সিদ্বান্ত নেওয়ার উপর তাদের কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রন থাকে না।

 

সমাজ বা পরিবারের ইচ্ছামত জীবন- যাপন করতে হয়। সমাজের বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা, রীতি-নীতি, কুসংস্কার এবং মতবাদগুলোকে চোখ বুঝে মেনে নিতে হয়। মাসিক স্বাস্থ্যও এর ব্যাতিক্রম নয়। পাহাড়ী নারীরা যে ধারণাগুলো লালনপালন করে আসছে বছরের পর বছর তা হলো মাসিক সময়ে মেয়েটি অশুচি হয়ে যায়, মাসিকের রক্ত পঁচা রক্ত, মাসিক চলাকালীন জুমে না যাওয়া, মন্দিরে না যাওয়া, মাসিক শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘরের বাইরে না যাওয়া, টক জাতীয় খাবার না খাওয়া, মাসিক সম্পর্কে খোলা মেলা আলোচনা না করা,মাসিকের কাপড়গুলো খোলা জায়গায় শুকাতে না দেওয়া ইত্যাদি।

 

মাসিককে ঘিরে বিভিন্ন সমাজের বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা, রীতি-নীতি, কুসংস্কার এবং মতবাদ প্রজনন স্বাস্থ্যেও উপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে তাদের অজান্তে। অবৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্যবিধির চর্চা পাহাড়ী নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় দ্রুততার সাথে এবং সংক্রমিত করে বিভিন্ন যৌন রোগে। কিন্তু ভৌগলিক অবস্থার কারণে সেবা কেন্দ্রগুলো অনেক দুরে থাকায় ২/৩ ঘন্টা পায়ে হেঁটে সেবা নিতে অনীহা এবং এসব ঝুঁকি মোকাবেলা করার পর্যাপ্ত সেবা কেন্দ্র ও সেবার সুযোগ না থাকায় তাদেরকে সেবা থেকেও বঞ্চিত হতে হয়।

 

পাহাড়ী নারীরা নিজেকে গুটিয়ে রাখার প্রবনতা থাকার কারণে অনেকে সেবা কেন্দ্রে গেলেও লজ্জায় সেবা কর্মীর কাছে এসব বিষয় খোলা খুলি আলোচনা করেন না । এসব সমস্যার কারণে তারা শরণাপন্ন হয় বৈদ্য, ওঝাঁ ও কবিরাজের কাছে। বেশির ভাগ সময় শিকার হন ভুল চিকিৎসার । ফলে বছরের পর বছর তারা প্রজনন সংক্রমণ সহ সিফিলিস, গনোরিয়া, ক্ল্যাামাইডিসের মত যৌন রোগে ভোগেন। সঠিক মাসিক ব্যবস্থাপনা করার ক্ষেত্রে পাহাড়ি অঞ্চলের আরো একটি কঠিন সমস্যা হচ্ছে পানির স্বল্পতা, বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে। এই সময় কাপ্তায় হ্রদে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় পানির স্তর অনেক নিচে চলে যায়, ফলে পাহড়ের চূড়ায় বসবাসকারী  পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে পড়তে হয় চরম দুর্ভোগে এবং এর সাথে সাথে ব্যহত হয় মাসিক ব্যবস্থাপনা। পর্যাপ্ত পানি না থাকার কারণে আদিবাসী নারীরা সঠিক ভাবে, সঠিক সময়ে মাসিকের কাপড় গুলো ধুতে না পারায় অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করতে থাকে, যাতাদের যৌন রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। 

 

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু কিছু মানুষের মধ্যে মাসিক সম্পর্কে জানা শোনা বৃদ্ধি পেলেও বৃহৎ পরিসরে এই বিষয়ে সচেতনতা আসা এখনো অনেক দেরী। মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে পরিবারের সদস্যরা, এর পাশাপাশি কমিউনিটির পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। বাড়াতে হবে সঠিক তথ্য সরবরাহ, জানতে হবে মাসিক কেনো রোগ নয়, এটি একটি প্রাকৃতিক বিষয়। এটি নিয়ে সকলের খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। দূর করতে হবে বছরের পর বছর চলে আসা ভ্রান্তধারণা, নিতে হবে স্বাস্থ্য সেবা।


সংকলনে: রিমি চাক্মা
সহোযোগিতায়: আওয়ারলাইভ্স, আওয়া হেল্থ, আওয়ার ফিউচারস রাংগামাটি সহযোগী সংগঠন ।

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত