তিন মাসে পাহাড়ে ১৮টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে

Published: 12 Sep 2022   Monday   

গেল জুন থেকে আগষ্ট মাস পর্ষন্ত ১৮টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬ জন খুন, শিশুসহ ৬ জন আহত, ১২ জন অপহরণ এবং অপহৃত ২ জনকে মিথ্যা মামলায় পুলিশের নিকট সোপর্দ, ১ জনকে আটক এবং ১৩ জন ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর কর্তৃক বিলাইছড়ির বড়থলিতে একটি ত্রিপুরা পাড়ায় এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে নিরীহ ৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা ও ২ শিশুকে গুরুতর জখম করা এবং তার পরবর্তীতে বড়থলি ও রোয়াংছড়ির আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ অঞ্চল থেকে তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরাদের একশ পরিবারের অধিক জুমচাষীকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

 

এদিকে দীর্ঘ ২৪ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়া এবং সরকারসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোর একের পর এক চুক্তি লংঘন এবং চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নানা ষড়যন্ত্র ও কার্যক্রমের কারণে পাহাড়ী সম্প্রদায়ের জাতীয় অস্তিত্ব চরম হুমকির সম্মুখীন। পাহাড়ী সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা তীব্র এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হচ্ছে।


সোমবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির(জেএসএস) জুন থেকে আগষ্ট তিন মাসের পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদনে এ  দাবী করা হয়েছে।


পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমার পাঠানো মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার, রাষ্ট্র ও বহিরাগত গোষ্ঠীর নির্মম ও নির্দয় ঔপনিবেশিক ও সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসনের কবলে পড়ে জুম্ম জনগণের সাধারণ মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ভূমি ও ভূখন্ডের অধিকার আজ প্রতিনিয়ত পদদলিত হয়ে চলছে। সরকার একদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন বন্ধ রাখাসহ চুক্তি বিরোধী নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে, বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক জনসংহতি সমিতিসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনকারী অধিকারকর্মী ও জনগণকে সুপরিকল্পিতভাবে অপরাধী (সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ) হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিনাবিচারে হত্যা ও আটক, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণ, মারধর, হয়রানি, হুমকি প্রদানের কার্যক্রম জোরালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার ও বিাভিন্ন সংস্থার ছত্রছায়ায় ও আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে কখনো উন্নয়ন, কখনো সড়ক ও পর্যটন নির্মাণ, কখনো রাবার বাগান, কখনো বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রমের নামে চলছে জুম্মদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, বসতভূমি ও জুমভূমি বেদখল, বাগান-বাগিচা ধ্বংসকরণ এবং বহিরাগত বাঙালি সেটেলারদের কর্তৃক অব্যাহত সাম্প্রদায়িক হামলা ও গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণের চেষ্টা।

 

অপরদিকে ইসলামী মৌলবাদীদের কর্তৃক অব্যাহতভাবে চলছে নিরীহ ও দরিদ্র জুম্মজনগণকে সুকৌশলে ইসলামে ধর্মান্তিতকরণ ও তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংসকরণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত অনুপ্রবেশ। ২০২২ সালের জনশুমারীতেও পরিষ্কার ও উদ্বেগজনকভাবে জুম্মদের জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়া ও সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে। যা স্পষ্টতই জুম্মদের জাতিগতভাবে বিলুপ্তকরণের ধারাকেই প্রতিফলিত করেছে।

 

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, জুন থেকে আগষ্ট মাসে নারী ও শিশুর উপর ৭টি যৌন ও শারীরিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৭জন পাহাড়ী নারী সহিংসতার শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ১ জনকে দলগত ধর্ষণসহ ২ জন পাহাড়ী নারীকে ধর্ষণ এবং ১ জনকে হত্যার চেষ্টাসহ ৪ নারী ধর্ষণের চেষ্টা এবং ১ জন হত্যার শিকার হয়েছে। এছাড়া বহিরাগত সেটেলারদের কর্তৃক ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছে ৪ জন নারী এবং আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ৫ জন নেতাকর্মী কর্তৃক সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় এক কলেজ ছাত্রী। লংগদুতে একজন স্কুল শিক্ষিকাকে কারা গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। বম পার্টি নামে খ্যাত কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সন্ত্রাসীরা বিলাইছড়ির বড়থলিতে একটি ত্রিপুরা পাড়ায় এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে নিরীহ ৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা ও ২ শিশুকে গুরুতর জখম এবং তার পরবর্তীতে বড়থলি ও রোয়াংছড়ির আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ অঞ্চল থেকে তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরাদের একশ এর অধিক জুমচাষী পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।


প্রতিবেদনে দাবী করা হয়, জুলাই-আগস্ট মাসে ভূমি জবরদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগ, মিথ্যা মামলা দায়ের সংক্রান্ত ৯টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তার মধ্যে মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও বহিরাগত মহল কর্তৃক জুম্মদের উপর ৩টি সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। এইসব ঘটনায় ৩৭টি জুম্ম গ্রামবাসীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট, ৪ জনকে আহত, একটি বৌদ্ধ মন্দিরে লুটপাট ও ভাঙচুর, একজন বহিরাগত বাঙালি ও একজন পাহাড়ি পর্যটন ব্যবসায়ী কর্তৃক দুইজন জুম্মর ৩ একর ভূমি বেদখল করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০ জন সেটেলার কর্তৃক ৩৭টি জুম্মর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে খাগড়াছড়ির মহালছড়ির মাইসছড়িতে এবং এতে ২ জুম্মকে আহত করা হয়। তবে আইন-শৃংখলা বাহিনী ঘটনাস্থলের পাশে উপস্থিত থাকলেও হামলাকারী সেটেলারদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।


প্রতিদেনে উল্লেখ করা হয়, বান্দরবানে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ভূমিদস্যুদের কর্তৃক আগষ্ট মাসে নিজেদের ৪০০ একর জুম ভূমি ও গ্রামীন বন রক্ষার জন্য আন্দোলনরত ১১ জন গ্রামবাসীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরো ১৫/২০ জনকে আসামী করে বান্দরবানের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে এক মামলা দায়ের করা হয়েছে। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং ম্রো ও ত্রিপুরাদের মধ্যেকার ৪০০ একর ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আগষ্ট মাসে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃক বেদখলকৃত ভূমি উদ্ধার করার পরিবর্তে ম্রো ও ত্রিপুরাদের ৩৯ পরিবারকে ৫একর ভূমি বরাদ্দের পর বাদবাকী ভূমি বেদখলকারী রাবার কোম্পানীকে দেয়ার জন্য পক্ষপাতমূলক প্রস্তাব করেন পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর ও বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তীবরীজি। ভূক্তভোগী ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীরা এই তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন বলে দাবী করা হয়েছে প্রতিবেদনে।


প্রতিবেদনে গেল জুন মাসের প্রথম থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বান্দরবানের থানচি ও আলীকদম উপজেলার দুটি ইউনিয়নে অন্তত ১২ জন জুম্ম গ্রামবাসীর মৃত্যু এবং প্রায় ৩৫০ জনের আক্রান্ত হয়েছে।  এদের মধ্যে থানচির রেমাক্রি ইউনিয়নে ৯ জনের মৃত্যু ও ৬০ জনের আক্রান্ত হওয়ার এবং আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নে ৩ জনের মৃত্যু ও ৩ শতাধিক ব্যক্তির আক্রান্ত হওয়ার পাওয়া গেছে। এছাড়াও সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলার পার্শ্ববর্তী কক্সবাজার জেলাধীন উখিয়া উপজেলার মনখালী চাকমা পাড়ার আদিবাসী চাকমাদের উপর একদল মুসলিম বাঙালি ভূমিদস্যু হামলা চালিয়ে নারীসহ ৫ জনকে গুরুতর জখমসহ ২০ জনকে আহত করেছে।
--প্রেস বিজ্ঞপ্তি।

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত