পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এ অঞ্চলে বিশেষ শাসন ব্যবস্থার কাঠামো প্রতিষ্ঠা পায়নি-সন্তু লারমা

Published: 25 Jan 2017   Wednesday   

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিন্দ্রি বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা) বলেছেন, দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় ধরে আন্দোলনের সংগ্রামের ফলে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়ায় এ অঞ্চলে বিশেষ শাসন ব্যবস্থার কাঠামো প্রতিষ্ঠা পায়নি। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের আইন কার্যকর হতে পারেনি।


পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী ক্ষুদ্র জাতিসত্বাদের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অধিকার এখনো স্বীকৃত হয়নি উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে সুশাসন ও সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় আজ এ অঞ্চলের অধিবাসীর কারোর নিরাপত্তা নেই। এ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে সেভ দ্য চিলড্রেন পাহাড়ের শিশুদের জীবনের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অস্তিত্ব এবং জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে আদর্শ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তা নিসন্দেহে এ অঞ্চলের মানুষকে উৎসাহিত করেছে। বেঁচে থাকার জন্য জীবনকে গড়ে তোলার জন্য।


বুধবার রাঙামাটিতে সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশুর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের মাতৃভাষা ভিত্তিক বহু ভাষিক শিক্ষার সুবিধোভোগীদের সাথে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা এসব কথা বলেন।


আশিকা হল রুমে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় আশিকা মানববিক উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক বিপ্লব চাকমার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মোঃ মানজারুল মান্নান, সেভ দ্য চিলড্রেনের শিক্ষা বিভাগের পরিচালক বুশরা জুলফিকার, প্রকল্প পরিচালক মেহেরুন নাহার স্বপ্না,জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান। স্বাগত বক্তব্যে রাখেন আশিকা মানববিক উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রকল্প কর্মকর্তা কক্সী তালুকদার। মতবিনিময় সভায় প্রকল্পের সুবিধাভোগী, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও জনপ্রতিনিধরা অংশ গ্রহন করেন।


অনুষ্ঠান শেষে মাতৃভাষা ভিত্তিক বহু ভাষিক শিক্ষায় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ২০ জন শিক্ষকদের মাঝে অভিজ্ঞতা সনদপত্র বিতরণ করেন প্রধান অতিথি।


সন্তু লারমা তার বক্তব্যে বলেন, স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তিতে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দান করা। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দান কতটুকু সম্ভব এ বিষয় নিয়ে অনেক চুক্তি তর্ক হয়েছে। তবে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে রাজনৈতিক শাসনতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।


তিনি অভিযোগ করে বলেন, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও অপারেশন উত্তোরণের নামে সেনাবাহিনী পূর্ন কর্তৃত্ব নিয়ে এ অঞ্চলে শাসন ও নিয়ন্ত্রন করছে। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর পার্বত্যাঞ্চলের বাস্তবতা নির্ভর করে।


সন্তু লারমা বলেন, আজকে এই মতবিনিময় সভায় জেলা পরিষদের কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি থাকা অবশ্যই দরকার ছিল। কারণ প্রাথমিক শিক্ষার বিভাগটি তাদের ন্যস্ত করা হয়েছে। অথচ এই অনুষ্ঠানের তাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। যদি তাদের মাসিক সমন্বয় সভা রয়েছে। কিন্তু এখানে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আসতে না পারলেও শিক্ষা বিভাগের যে সদস্য দায়িত্বে রয়েছেন তার উপস্থিত থাকা উচিত ছিল। কারণ তার বক্তব্যে সবচেয়ে জরুরী।


প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে উপজেলা পরিষদের অনেক ভূমিকা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারাদেশে উপজেলা পরিষদের বিধিমালায় দেখা যায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সর্বেসর্বা। অথচ মূল দায়িত্ব পালন কথা ছিল চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের। তিনি এ উপজেলা পরিষদকে গণবিরোধী আইন উল্লেখ অবিলম্বে তার সংশোধন আনা দরকার বলে মত দেন।


তিনি অভিযোগ করে বলেন, সাধারন প্রশাসন ও আইন-শৃংখলার বিষয়ে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে একটা দুরত্ব বা প্রাচীর সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। যাতে এখানে উন্নয়নের স্বাভাবিক কর্মকর্তান্ড বা উন্নয়নের সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে না পারে। তা না হলে নিমর্ম বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ নিরাপত্তা বলয়ের মধ্য দিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে। তারা তাদের জীবন ধারাকে এগিয়ে নেওয়ার অপ্রাণ সংগ্রামে যুক্ত থাকতে হচ্ছে। তারপরও এই কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা  চলছে।


তিনি মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার কাজটি কঠিন উল্লেখ করেন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সব প্রি প্রাইমারী বিদ্যালয়ে সবচেয়ে যে সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ছাত্র-ছাত্রী বেশী রয়েছে সেই বিদ্যালয়ে সেই ভাষাভাষি শিক্ষক নিয়োগের বাধ্যতামূলক করা উচিত। অথচ সরকার যে এলাকায় বাংলা ভাষাভাষি ছাত্র নেই সেখানে বাংলা ভাষাভাষি শিক্ষককে নিয়োগ দিচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ে সরকার কাদেরকে নিয়োগ দিচ্ছে। এখানেও শাসন ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা ও গণবিরোধী ব্যবস্থাপনা রয়েছে। তাই যে বিদ্যালয়ে যেসব সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ছাত্র-ছাত্রী বেশী রয়েছে সেই বিদ্যালয়ে সেই ভাষাভাষি শিক্ষক নিয়োগের বাধ্যতামূলক করা না হলে এ বিষয়ে সফল হওয়া সম্ভব নয়।


জেলা প্রশাসক মোঃ মানজারুল মান্নান বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে প্রি স্কুল রাখা যায়। সরকার পদক্ষেপ নিতে পরে। তিনি আরো বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষার সব ধরনের বই ইতোমধ্যে চলে এসেছে। অতিদ্রুত এইসব বই প্রত্যান্ত এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে প্রেরণ করা হবে। তিনি মাতৃভাষা ভিত্তিক বহু ভাষিক শিক্ষার প্রকল্পটি ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সেভ দ্য সিলড্রেনের প্রতি আহ্বান জানান।


সেভ দ্য চিলড্রেনের শিক্ষা বিভাগের পরিচালক বুশরা জুলফিকার বলেন, সেভ দ্য চিলড্রেন শিশুদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিয়ে ভিশন ২০-৩০ রয়েছে। তাই প্রতিটি শিশুকে বাচাঁকে শিক্ষা এবং সুরক্ষা দিতে হবে। কোন শিশুই বাদ যাবে না। মায়ের ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহন করা হলে সেই ভাষা উন্নত হয়। তাই মাতৃভাষাকে এরিয়ে গিয়ে জাতীয় ভাষায় শিক্ষা গ্রহন করা ঠিক নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মাতৃভাষা ভিত্তিক বহু ভাষিক শিক্ষার প্রকল্পটি ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেন তিনি।


জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশুদের মাতৃভাষার সমস্ত বই পৌছেছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে সকল বিদ্যালয়ে বই পৌছানো হবে। তিনি আরো বলেন, মাতৃভাষায় পাঠদানের উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে মাতৃভাষার উপর প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ৫০ জন শিক্ষককে দিয়ে পাঠদান চালানো হবে। শিক্ষকদের মাতৃভাষার উপর প্রশিক্ষনের জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।


উল্লেখ্য,সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশুর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের আওতায় ২০০৬ সাল থেকে তিন পার্বত্য জেলায় মাতৃভাষা ভিত্তিক বহু ভাষিক শিক্ষার উপর কাজ করে যাচ্ছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত