মোটরবাইক চালক হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে লংগদুতে পাহাড়ীদের বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ,১৪৪ ধারা জারি

Published: 02 Jun 2017   Friday   

স্থানীয় যুবলীগ নেতা ও ভাড়ায় চালিত মোটরাইক চালক নূরুল ইসলাম নয়নের হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার রাঙামাটির লংগদুতে তিনটিলা পাড়া ও মানিকজুড় ছড়াসহ  পাহাড়ীদের চারটি গ্রামের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় পুলিশ ৩ জনকে আটক করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে উপজেলা প্রশাসনের এখনো ১৪৪ ধারা বলবৎ রয়েছে।

 

এদিকে স্থানীয় লোকজন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি দাবী করেছে অগ্নিকান্ডে লংগদুতে চারটি গ্রামে অগ্নিকান্ডে আড়াই শতের অধিক পাহাড়ীদের বসতঘর ও দোকাপাট সম্পুর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে। এ ঘটনায় গুনমালা চাকমা নামের ৮০ বছরের এক বৃদ্ধা নিহত হয়েছে।

 

উল্লেখ্য, গেল বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি উপজেলা সদরের খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের চার মাইলের যৌথ খামার এলাকায় ভাড়ায় চালিত মোটরবাইক চালক নূরুল ইসলাম নয়নের লাশ উদ্ধার করা হয়।

 

স্থানীয় লোকজন জানায়,শুক্রবার সকালে খাগড়াছড়ি আধুনিক হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর নয়নের লাশ লংগদু উপজেলা সদরের বাট্ট্যা পাড়ায় নিয়ে যাওয়ায় হয়। লাশ বাট্ট্যাপাড়ায় পৌছার পর স্থানীয় বাঙালীরা সেখানে জড়ো হতে থাকে। পরে সেখান থেকে লাশ নিয়ে লংগদু সদরের বিক্ষোভ-মিছিল বের করে। মিছিলসহকারে  যাওয়ার পথে এক পর্যায়ে উচ্ছৃংখল লোকজন লংগদু উপজেলা সদরের তিন টিলা পাড়া এলাকায় পাহাড়ীদের ঘরবাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে দেয়। উচ্ছৃংখল লোকজন বাত্যাপাড়া, উত্তর ও দক্ষিন মানিকজুড়, বড়াদম এলাকায় পাহাড়ীতের বসতবাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি  নিয়ন্ত্রণে আনতে উপজেলা প্রশাসন লংগদু সদর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। এ ঘটনায়  পুলিশ খায়ের,সন্তোষ ও সবুজ নামের ৩ জনকে আটক করেছে। বর্তমানে এলাকায় পুলিশের পাশাপাশি সেনা বাহিনী ও বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে। নিহত নয়নের লাশ জানাজার পর শুক্রবার বিকালে বাট্ট্যা পাড়া এলাকায় দাফন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

 

অপরদিকে,পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দাবী করেছেন নুরুল ইসলাম নয়ন নামে একজন সেটেলার বাঙালি মোটরবাইক চালকের লাশ উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গতকাল  সকাল ৯টার দিকে  আইন-শৃংখলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় লংগদু উপজেলায় বাট্ট্যা পাড়া থেকে সেটেলার বাঙালিদের এক জঙ্গী সাম্প্রদায়িক মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি আনুমানিক ১০টার দিকে লংগদু সদরের তিনটিলা এলাকায় পৌঁছলে সেটেলার বাঙালিরা কোন উস্কানী ছাড়াই জনসংহতি সমিতির অফিসসহ জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ঘরবাড়ি লুটপাটসহ জুম্মদের উপর হামলা করতে শুরু করে।

 

এতে তিনটিলা এলাকায় জুম্মদের ২শ এর অধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়।পরে সেটেলার বাঙালিরা পার্শ্ববর্তী মানিকজুরছড়ায় হামলা করতে যায়। এতে জুম্মদের বসতিতে অগ্নিসংযোগ করলে কমপক্ষে ৪০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ছাই হয়ে যায়।  প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো দাবী করা হয়, দুপুরের দিকে স্থানীয় প্রশাসন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করলেও  সেটেলার বাঙালিরা দক্ষিণ মানিকজুরছড়া, বাত্যা পাড়া ইত্যাদি জুম্ম গ্রামে অগ্নিসংযোগ শুরু করেছে।

 

প্রেস বার্তায় পাহাড়ীদেও জায়গা-জমি জবরদখল ও স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা, সর্বোপরি জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার হীন উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র তথা শাসকশ্রেণির মদদে এই হামলা সংঘটিত হয়েছে দাবী করে   অগ্নিসংযোগ ও হামলার সাথে জড়িতদে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানানো হয়েছে।

 

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিকফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)-এর রাঙামাটি জেলা ইউনিটের প্রধান সংগঠক শান্তি দেব চাকমা সংবাদ মাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে লংগদুতে পাহাড়িদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও তিনশতাধিক ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

 

বিবৃতিতে তিনি এ হামলাকে পরিকল্পিত আখ্যায়িত করে বলেছেন, অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে। পাহাড়িরা প্রাণের ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে এলাকায় আতঙ্কজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

 

বিবৃতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পসৃষ্টি করার মাধ্যমে জুম্ম জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে নস্যাৎ করা ও তাদেরকে নিজভূমি থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যেই পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়েছে।

 

তিনি অবিলম্বে লংগদুতে সাম্প্রদায়িক হামলার সুষ্ঠুবিচার বিভাগীয় তদন্ত, ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও নিরাপত্তা বিধান করা এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

 

লংগদু সদর ইউপি চেয়ারম্যান কুলিন মিত্র চাকমা আদু দাবী করেছেন,তিনটিলা এলাকায় অগ্নিকান্ডে গুনমালা চাকমা নামের ৮০ বছরের বৃদ্ধা নিহত হয়েছে।

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির লংগদু উপজেলা শাখার সাধারন সম্পাদক মনিশংকর চাকমা জানান, অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর এলাকার পাহাড়ী লোকজন  অন্যত্র পালিয়ে গেছে।  বর্তমানে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় টহল দিচ্ছে। তিনি আরো জানান, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় তিনটিলা এলাকায় গুনমালা চাকমা নামের এক বৃদ্ধা নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় বাট্টা পাড়া এলাকায় প্রভাত চন্দ্র চাকমা ও তার স্ত্রী নিখোজ রয়েছেন।

অপরদিকে, উদ্ভূত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার দুপুরের দিকে লংগদু উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক প্রকাশ কান্তি চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশেষ আইন শৃঙ্খলা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় লংগদু জোনের জোন কমান্ডার আব্দুল আলিম চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শফিউল সরোয়ার, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তোফাজ্জেল হোসেন সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সভায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরূপন করে ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা দেয়ার আশ্বাস প্রদান করা হয় এবং দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঘটনা যতক্ষণ স্বাভাবিক না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত  ১৪৪ ধারা বলবৎ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

 

লংগদু উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ তৈয়ব জানিয়েছেন এ পর্ষন্ত  অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ ৭৩টি বাড়ী তালিকা করা হয়েছে।

 

লংগদু  উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা তাজউল ইসলাম জানান, অগ্নিসংযোগের  ঘটনায় ২০ থেকে ৩০টি বাড়ী পুড়ে গেছে। এলাকার পরিস্থিতি শান্ত রাখতে  লংগদু উপজেলা সদরে ১৪৪ ধারা বলবৎ রয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।

 

জেলা পুলিশ সুপার মোঃ তারিকুল হাসানকে সংঘটিত অগ্নিকান্ড, পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি, দোকানপাট এবং আগুনে পুড়ে মানুষ মারা যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান,ইতোমধ্যে ৩জনকে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততার সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে হতাহতদের ব্যাপারে লংগদু থানা এখনো কোন লিখিত প্রতিবেদন না পাঠানোর কারনে কোন তথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

 

লংগদু উপজেলা সদরে সংঘটিত সহিংস ঘটনা সম্পর্কে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারারুল মান্নান এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান,ঘটনা নিয়ন্ত্রনে উপজেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে ১৪৪ ধারা জারী করেছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ ও সেনা সদস্যের টহল অব্যাহত রয়েছে। পাশপাশি ক্ষতিগ্রস্থদের ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা চলছে।

 

 যুব লীগের বিক্ষোভ-সমাবেশ

মোটর সাইকেল চালক ও যুবলীগ নেতা নয়নের হত্যার প্রতিবাদে রাঙ্গামাটি জেলা সদরে গতকাল শুক্রবার দুপুরে জেলা যুবলীগের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। রাঙামাটি পৌরসভা চত্বর থেকে শুরু করে বনরূপার আলিফ মার্কেট চত্বরে সমবেত হয়ে প্রতিবাদকারীরা এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। জেলা যুবলীগের সভাপতি ও রাঙমাটি পৌরসভার মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় বক্তব্য রাখেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল জব্বার সুজন, শহর যুবলীগের মোঃ আবুল খায়ের, সাওয়াল উদ্দীন ও উদয় শংকর চাকমা প্রমুখ নয়ন হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করেন।

 

 পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদের বিক্ষোভ-সমাবেশ

নিহত নয়নের হত্যার প্রতিবাদে হত্যাকারীদের দ্রুততম সময়ে গ্রেফতার ও যথাযথ শাস্তির দাবী জানিয়ে পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদ শহরের বনরূপা পেট্রোলপাম্প চত্ত্বরে এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে পার্বত্য নাগরিক পরিষদের জেলা শাখার সভাপতি নুরজাহান বেগম, বাঙালী ছাত্র পরিষদের জেলা শাখার সভাপতি  জাহাঙ্গীর আলম ও বাঙালী ছাত্র পরিষদের পৌর শাখার সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

 --হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত