পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ একটি মহাশ্মশানে পরিণত হয়েছে-সন্তু লারমা

Published: 10 Nov 2017   Friday   

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা) অভিযোগ করে বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন করেছিল। কিন্তু সেই চুক্তির ২০ বছর অতিক্রান্ত হলেও বাস্তবায়িত হতে পারছে না এবং সরকার বাস্তবায়ন করছে না। এখানে ষোলো আনা সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। পার্বত্যাঞ্চল যেখানে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ একটি মহাশ্মশানে পরিণত হয়েছে।


তিনি অভিযোগ করে আরো বলেন, সেনা শাসন, গোয়েন্দা বাহিনী, এখানকার আমলা বাহিনী, ক্ষমতাসীন দলের সেটেলারদের মিলিতভাবে যে দমন-পীড়ন, নির্যাতন, শোষণ, বঞ্চনা আজকে সীমাহীন পর্যায়ে চলে গেছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আমাদের নিরাপত্তাহীন, অনিশ্চিত জীবন নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এ জীবন আমরা মেনে নিতে চাই না এবং আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত নই। সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন চায় না। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করতে চায়। সেজন্য আজ জুম্ম জনগণের জীবন এক নিরাপত্তাহীন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় বিরাজ করছে।

 

শুক্রবার রাঙামাটিতে প্রয়াত সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার(এমএন লারমা) ৩৪ তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণ সভায় প্রধান আলোচকের বক্তব্যে সন্তু লারমা এ অভিযোগ করেন।


‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপপন্থী সকল কার্যক্রম প্রতিরোধ করুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে অধিকতর আন্দোলন সংগঠিত করুন’Ñ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জেলা শাখার উদ্যোগে জেলা শিল্পকলা একামেী চত্বরে আয়োজিত স্মরণ সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জেলা শাখার সভাপতি সুবর্ণ চাকমার। আলোচক ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য গৌতম কুমার চাকমা, আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম মুহলা সমিতির সভানেত্রী কল্পনা চাকমা, বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী রনজিত দেওয়ান।

 

অন্যান্যর মধ্যে বক্তব্যে দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির সভাপতি অরুন ত্রিপুরা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদেও সাধারন সম্পাদক সুমন মারমা। জনসংহতি সমিতির জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নীলোৎপল খীসা ও সদস্য সুপ্রভা চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় শোক প্রস্তাব পাঠ করেন জনসংহতি সমিতির ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক ত্রিজিনাদ চাকমা। স্মরণ সভা শুরুর আগে আন্দোলন সংগ্রামের নিহতের প্রতি দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।


এর আগে সকালের দিকে খালি পায়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমী চত্বও থেকে শুরু হয়ে শহরের বনরুপা এলাকা ঘুরে আবার জেলা শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। জেলা শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বিধিতে ফূল দিয়ে জানান সন্তু লারমাসহ বিভিন্ন সংগঠন। বিকালে কবিতা পাঠের আসর এবং সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও ফানুস বাতি উড়ানো হয়।


সন্তু লারমার তার বক্তব্যে আরো বলেন, ১০ নভেম্বর ’৮৩-তে এম এন লারমাসহ অনেককে নৃশংস হত্যা ছিল একটি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। এই হত্যাকান্ডের পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র জড়িত ছিল। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে ধ্বংস করার হীনউদ্দেশ্যে বিভেদপন্থী চার কুচক্রী দ্বারা সেই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। মহান নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল সেই কুচক্রী মহল। সেই বিভেদপন্থী, সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এখনো সক্রিয় রয়েছে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য তারা বর্তমানে উঠে পড়ে রয়েছে।


সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সতর্ক হওয়ার ও তাদের প্রতিরোধ করার হওয়ার কথা উঠে এসেছে উল্লেখ করে সন্তু লারমা বলেন, জুম্ম সমাজে যারা সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, সরকার-শাসকগোষ্ঠীর লেজুর হয়ে নিজেদের স্বার্থ পরিপূরণে সবসময় যারা সচেষ্ট রয়েছে তাদের সম্পর্কে আজকের স্মরণ সভাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে তাদের ব্যাপারে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে, আরও সংগ্রামী হতে হবে। দরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের লড়াই-সংগ্রামকে আরো উজ্জীবিত করা ও নিজেকে আরো সমর্পিত করা।


তিনি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ছাত্র ও যুব সমাজ থেকে সবাইকে আরো সক্রিয়ভাবে আন্দোল সংগ্রামে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।


এদিকে এমএন লারমা মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে রাঙামাটির রাজ বন বিহারে এমএন লারমার উদ্দেশ্য দান কার্য সম্পাদনসহ নানান ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা হয়।


পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, ষাট দশকে ছাত্র-যুব সমাজের প্রতি এম এন লারমার আহ্বান ছিল ‘গ্রামে চলো’। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত শত যুবক গ্রামে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেছিলেন। এম এন লারমা নিজেও শিক্ষকতা করেছিলেন। শিক্ষকতার মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষায় সচেতন করেছিলেন। শিক্ষার পাশাপাশি ঘুমন্ত জুম্ম সমাজকে রাজনৈতিকভাবে জাগরিত করেছিলেন। তিনি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতা নন, তিনি সমগ্র দেশের নেতা ছিলেন।


তিনি আরো বলেন, উনসত্তরে অন্যতম জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল সব কথার শেষ কথা স্বায়ত্তশাসিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু কতটুকু তা অর্জিত হয়েছে? তবে তা একেবারেই বিফল হইনি। তাই আমাদের আরো কঠোর আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করেই সেই সফলতার পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হবে।


আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য ও জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা গৌতম কুমার চাকমা বলেন, এম এন লারমা ছিলেন মহান ব্যক্তিত্ব। তার ক্ষমতা গুণ, শিক্ষা গ্রহণের গুণ, পরিবর্তন হওয়ার গুণ রয়েছে। তারই আলোকে বিভেদপন্থীদেরকে ‘ক্ষমা করা ভুলে যাওয়া’ নীতির ভিত্তিতে ক্ষমা করা ও পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা সফল হয়নি।


তিনি আরো বলেন, এমএন লারমা বলেছিলেন, আমাদের প্রধান কাজ হবে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। জুম্ম সমাজের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা থেকে মানুষকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। এজন্য তিনি সাংগঠনিক নীতি দিয়েছিলেন যেটায় তিনি বলেছিলেন, শত্রুকে নিরপেক্ষ করতে হবে, নিরপেক্ষকে সক্রিয় করতে হবে।


আওয়ামীলীগের এক নেতার বক্তব্য উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও এদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক হতে পারেনি। তাই দেশের দশমিক এক শতাংশ মানুষ পার্বত্য চুক্তির পক্ষে থাকলেও ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ চুক্তি বিরোধী। এই বাস্তবতা মনে রেখেই সবাইকে কাজ করে যেতে হবে।


উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এমএন লারমা ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভিদেপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন গ্রুপের হাতে তার ৮ সহযোগীসহ শহীদ হন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১৩ ভাষাভাষি পাহাড়ি জাতি গোষ্ঠী সমূহের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সত্তরের দশকে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এম এন লারমা। দেশ স্বাধীনের আগে গণপরিষদ এবং দেশ স্বাধীনের পর প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। দেশের প্রথম সংবিধান রচনায় সংসদীয় আলোচনায় তিনি দক্ষতা ও বাগ্মীতার পরিচয় দেখিয়েছিলেন।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

 

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত