পাওয়া না পাওয়া,ক্ষোভ আর হতাশার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চুক্তির ২১তম বর্ষপূর্তি হতে যাচ্ছে

Published: 01 Dec 2018   Saturday   

রোববার ২ডিসেম্বর। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২১ তম বর্ষপূর্তি। তবে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকারী পক্ষ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্কের শেষ হয়নি। সরকার পক্ষ বলছে চুক্তির সিংহভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে। অর্থাৎ চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। চুক্তির বাকী শর্ত বা ধারাগুলো পর্যায়ে বাস্তবায়নে পথে রয়েছে।

 

পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ  দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে  ১৯৯৭ সালের এই দিনে(২ডিসেম্বর) ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি শর্ত মোতাবেক ১৯৯৮সালের ১০ফের্রুয়ারী থেকে ২৯ মার্চ পর্ষন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির‌্য(তৎকালীন  সামরিক শাখার শান্তি বাহিনী) প্রায় দুই হাজার সদস্য মোট চার দফায় অস্ত্র জমাদানের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কর্তৃক পার্বত্য চুক্তির পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুদশক উপলক্ষে চুক্তি সম্পাদনকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার বিভাগ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে একটি বুকলেট প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান এখনো অর্জিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম (উপজাতীয়) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ সুনিশ্চিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ইত্যাদিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়নি। তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, মাধ্যমিক শিক্ষাসহ সকল প্রকার উন্নয়ন কার্যক্রম ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন করা হয়নি। সেটেলার বাঙালি, অস্থানীয় ব্যক্তি ও কোম্পানী, সেনাবাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভূমি বেদখল বন্ধ হয়নি এবং ভূমি বেদখলের ফলে উদ্ভূত পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি বিরোধ এখনো ভূমি কমিশনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন কার্যকর করা হয়নি। ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ র্প্বূক যথাযথ পুনর্বাসন প্রদান করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে পাহাড়িদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ সুনিশ্চিত হয়নি এবং সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন প্রদান করা হয়নি।

 

গেল ২৯ নভেম্বর ঢাকার সুন্দরবন হোটেলে পার্বত্য চুক্তির দুদশক উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সন্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদ   চেয়ারম্যান   জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা) বলেছেন, ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দুই মেয়াদে এক দশক ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। উপরন্তু দেশে-বিদেশে অপপ্রচার চালাতে থাকে যে, ‘পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে’, ‘চুক্তির ৮০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে’, ‘সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে সম্পূর্ণভাবে আন্তরিক’, ‘এ সরকারের আমলেই চুক্তির অবশিষ্টাংশ সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হবে’ ইত্যাদি। আবার ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে, ‘পৃথিবীর কোন চুক্তিই ১০০ ভাগ বাস্তবায়িত হয়নি, পার্বত্য চুক্তির মতো বিশ্বের কোন চুক্তিই এত দ্রুত বাস্তবায়িত হয়নি’ ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার কেবল চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত অবস্থায় ফেলে রেখে দেয়নি, উপরন্তু একের পর এক চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তির কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে।

 

তিনি আরো বলেন, ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং মৌলিক বিষয়সমূহসহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে জনসংহতি সমিতির সভাপতির পক্ষ থেকে গত ১ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যেসব বিষয় বাস্তবায়িত হয়নি তার বিবরণ” সম্বলিত ১৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন এবং তৎসঙ্গে সহায়ক দলিল হিসেবে ১৬টি পরিশিষ্ট সংযুক্ত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট জমা দেয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, অধিকন্তু গোয়েবলসীয় কায়দায় অব্যাহতভাবে অসত্য তথ্য প্রদান করে চলেছে।

 

অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে সেনা-পুলিশের যোগসাজশে ক্ষমতাসীন দল জনসংহতি সমিতির সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করে চলছে এবং অবৈধভাবে ধর-পাকড় ও নিপীড়ন-নির্যাতন করছে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর এ ধরনের ফ্যাসীবাদী অত্যাচার-উৎপীড়নের মূল উদ্দেশ্য হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা এবং জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা।

 

এদিকে,সরকারী দলীয় সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ ফিরোজা বেগম চিনুর কেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাহাড়ের মানুষের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে, তিনি পাহাড়ের মানুষকে ভালবাসেন উল্লেখ করে বলেছেন,পার্বত্য শান্তি চুক্তি  সিংগভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে। পার্বত্য ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার কাজ চলছে। আগামীতে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করতে পারলে চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন করবে।

 

রাঙামাটি আসনের সাংসদ ও জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি উষাতন তালুকদার  বলেন,  পার্বত্য চুক্তির যে স্পিরিট ছিল এখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে এবং আলাদা শাসন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রুপর দেয়ার ক্ষেত্রে এখনো আশা ব্যঞ্জক রুপ দেখা যায়নি। বিশেষ পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষকদে অর্থব করে রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সামনে নির্বাচন তাই সকল রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইস্তেহারে চুক্তি বাস্তবায়নে রোড ম্যাপসহ সুনির্দিষ্টভাবে চুক্তির কোন ধারা কখন কোনটা বাস্তবায়ন করা হবে তা ইস্তেহারে আসা উচিত। এছাড়া যে সরকার ক্ষমতায় আসুক না কেন সেই সরকারের উচিত হবে পার্বত্য সমস্যাকে ঝুলিয়ে না রেখে চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্য  দিয়ে এলাকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।

 

চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেন,পার্বত্য চুক্তির মূল মুল যে বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলোর মধ্যে কেবল এ অঞ্চলের সংঘাতের অবসান এবং অস্ত্রধারী জনসংহতি সমিতির যারা সদস্য রয়েছেন তারা  সাধারন জীবনে ফিরে এসেছেন। এই দুটো জিনিস ছাড়া চুক্তিকে কেন্দ্র করে কিছু প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি বা ক্ষমতায়ন হয়েছে।   কিন্তু  চুক্তির অন্যান্য মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। 

 

এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সমস্যা ভূমি সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষে গত বছর ১ আগস্ট ‘পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬’ এর খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ওই বছরও ৬ অক্টোবর জাতীয় সংসদে সংশোধিত বিল আকারে পাস করা হয়। সংশোধিত এ কমিশনের  এ পর্ষন্ত ভূমি বিরোধ নিয়ে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিদের কাছ থেকে গণ বিজ্ঞপ্তি ছাড়া কোন কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। এছাড়া পার্বত্য খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের কার্যালয় স্থাপন করা হলেও পর্যাপ্ত জনবল, তহবিল ও পরিসম্পদ নেই। তহবিল, জনবল ও পারিসম্পদের অভাবের কারণে এখনো রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলায় শাখা কার্যালয় স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর রাঙামাটিতে ভূমি কমিশনের বৈঠকে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বিধিমালা চুড়ান্ত হলেই কমিশনে জমা পড়া ২২ হাজার আবেদনের শুনানী কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ার উল হক। তিনি আরো জানিয়েছেন  ইতোমধ্যে ভূমি কমিশনের বিধিমালা খসড়া তৈরী হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এই খসড়ার উপর সংশোধনী দেয়ায় তা চুড়ান্ত করণের পর্যায়ে রয়েছে। সহসা এই বিধিমালা প্রনীত হলে ভূমি কমিশনে জমা পড়া বিরোধ সংক্রান্ত আবেদনের শুনানী শুরু করা যাবে।

 

চুক্তির বর্ষ পূর্তিতে রাঙামাটিতে কর্মসূচিঃ

পার্বত্য চুক্তির দুদশক বর্ষপূতি উপলক্ষে জেলা আওয়ামীলীগের উদ্যোগে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদোগে জেলা শিল্পকলা একােিডমী মিলনায়তনে আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন রাঙামাটি আসনের নির্বাচিত সাংসদ উষাতন তালুকদার নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ।  এছাড়া  জেলা পরিষদের উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিকালে জেলা পরিষদ ও সেনা বাহিনীর উদ্যোগে মারী স্টেডিয়ামে মনোজ্ঞ কনর্সাট অনুষ্ঠিত হবে।

--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

 

 

 

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত