স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও আদিবাসীরা মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত-সন্তু লারমা

Published: 03 Aug 2019   Saturday   

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা) অভিযোগ করেছেন স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও দেশের ৩০লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত।

 

তিনি বলেন, সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আদিবাসী ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং‘পপুলেশন ট্রান্সফার’ ও ক্রমাগত উচ্ছেদের ফলে নিজ ভূমি থেকে বাস্তুচূত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম, গারো পাহাড়, উত্তর বঙ্গ,গাজীপুর,মধুপুর বনাঞ্চল, পটুয়াখালী-বরগুনা, খাসিয়া অঞ্চলে সর্বত্র আদিবাসীরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। এমতাবস্থায় আদিবাসীদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা এখন আত্মপরিচয়, মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

 

আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটাপন্ন উল্লেখ করে সন্তু লারমা বলেন,দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে  উচ্ছেদ করার হীন উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ওউচ্ছেদ, আদিবাসী নারীর উপর ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ নৃশংস সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।

 

তিনি অভিযোগ করে বলেন,পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২১ বছর অতিবাহিত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুধু ধীরগতি নয়, অনেকটা থমকে রয়েছে আর পাহাড়ের মানুষ সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দুর্বিসহ জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের অবস্থাি আরও সংকটাপন্ন। সরকার বার বার সমতলের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন করেনি। এই বিষয়ে ন্যূনতম পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো লক্ষণ নেই।


মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউটের নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় পাওয়া ১৪ টি বিপন্ন ভাষার কথা উল্লেখ করেন তিনি আরো বলেন, খাড়িয়া, কোড়া, সৌরা, মুন্ডারি,কোল,মালতো, খুমি, পাংখোয়া,রেংমিটচা,চাক,খিয়াং,লুসাই ও পাত্র ভাষা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং এই ভাষা চর্চাকারী মানুষদের সংখ্যা কমে যাওয়া থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের ক্রমাগত বঞ্চনার ফলেই এই বেহাল দশা বলে তিনি অভিযোগ করেন।


৯ আগষ্ট জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে রাজধানী ঢাকায় হোটেল সুন্দরবনে আয়োজিত এক সংবাদ সন্মেলন পাহাড়ের এই গেরিলা নেতা সন্তু লারমা এসব কথা বলেন। এবারের আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবসের মূল প্রতিপাঠ্য বিষয় হচ্ছে “আদিবাসী ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে এগিয়ে আসুন”।


সংবাদ সন্মেলনে আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের পরিচালনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আইইডির নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার কর্মী নুমান আহমদ খান, রিচার্স এন্ড ডেভলপমেন্ট কালেক্টিভএর সাধারন সম্পাদক ও আদিবাসীবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের টেকনোক্রেট এক্সপার্ট মেম্বার জান্নাতুল ফেরদৌসি,বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামেরসহ-সভাপতি অজয় এ মৃ,খাসিয়া নেতা এন্ড্র সুলেমার প্রমুখসহ আদিবাসী নেতৃবৃন্দ।


মূল বক্তব্যে সন্তু লারমা বলেন, জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ আদিবাসীদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। শিক্ষা নীতির ৭ নং ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অনু”েছদে বলা হয়েছে, “জাতি, ধর্ম, গোত্র-নির্বিশেষে আর্থ-সামাজিক শ্রেণী-বৈষম্য ও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ গড়ে তোলা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।” ২৩ নং লক্ষ্যে বলা আছে, “দেশের আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানো। ”জাতীয় শিক্ষা নীতির “আদিবাসী শিশু” অনুচ্ছেদে লেখা  রয়েছে, “আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষায় শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্য পুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে। এই কাজে, বিশেষ করে পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নে, আদিবাসী সমাজকে সম্পৃক্ত করা হবে। আদিবাসী প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।

 

তিনি আদিবাসীদের শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষা নীতির যথাযথ বাস্তবায়নের দাবি ও আদিবাসী অঞ্চলের স্কুলগুলোতে অবিলম্বে বিশেষ ব্যবস্থায় আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগের জানান।


আক্ষেপ ও দুঃখের বহিঃপ্রকাশও করে বলেন, আদিবাসী জাতিসমূহের জীবনধারা, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার,আদিবাসী জাতিসমূহের ভাষা ও সংস্কৃতি তথা আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্য রাষ্ট্র, জাতি সংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, সংখ্যা গরিষ্ঠ অ-আদিবাসী জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করে তোলা এবং আদিবাসীদের অধিকারের প্রতিসমর্থন বৃদ্ধি করাই হলো আদিবাসী দিবস উৎযাপনের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশে এই কাজগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের দরুণ রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দিবস পালিত হচ্ছে না।


আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও অন্যান্য সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচীর ঘোষনা করেন। এর মধ্যে ৪ আগস্ট সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আলোচনা সভা,৫ আগস্ট সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মূল অনুষ্ঠান- সমাবেশ, র‌্যালী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উক্ত অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধক হিসেবে এবং অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, প্রাক্তণ চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়াও দেশের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ উপস্থিত থেকে সংহতি জানাবেন, ৭ আগস্ট সকাল ১০ টায়ঢাকার ডব্লিউ.ভি.এ মিলনায়তনে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের যৌথ আয়োজনে আদিবাসী নারীর অধিকার বিষয়ক সেমিনার, ৯ আগস্ট বেলা ২ টায় বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায়ছাত্র সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ২৭ আগস্ট এএলআরডি ও ১০টির অধিক সংগঠন মিলিতভাবে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিয়ে সেমিনার আয়োজন করবে ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে।

 

এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও মহানগরের মধ্যে রাজশাহী, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, ময়মনসিংহ, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল (মধুপুর), গাজীপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, শেরপুর, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার প্রভৃতি স্থানে আদিবাসী দিবস উদযাপন করা হবে বলে তিনি ঘোষনা দেন।

 

আদিবাসীবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের টেকনোক্র্যেট এক্সপার্ট মেম্বার জান্নাতুল ফেরদৌসি বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার। এই চেতনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রূপকে ফুটিয়ে তোলার জন্য আদিবাসীদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। 


আইইডির নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমদ খান বলেন, জাতি সংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের যে কর্তব্য ছিল আর বর্তমান আদিবাসীদের যে হাহাকার বাস্তবতা বেশ বিপরীত। এসডিজির চলমান স্লোগান ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ এই নীতি বাস্তবায়নে সবচেয়ে প্রান্তিক আদিবাসী জনগনকে উন্নয়নের আলোয় নিয়ে আসার জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে। সকল আদিবাসীর ভাষা ও পরিচয়কে স্বকিৃতি দানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাস্তবায়নেরও তিনি দাবী জানান।

--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

 

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত