প্রশিক্ষিত শিক্ষককের অভাবে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানে সফলতা আসছে না

Published: 09 Aug 2019   Friday   

শিউলি চাকমা ও প্রভাতি চাকমা দুজনেই পাচ বছরের শিশু। এই শিশুরা রাঙামাটি পার্বত্য জেলার জুরাছড়ি উপজেলার শিলছড়ি মোন পাড়াই বাবা ও মায়ের সাথে থাকে। তারা পাহাড়ের সবুজ পাখির কলতান, ঝর্নার নির্মল ধারা আর প্রানপ্রিয় চাকমা ভাষায় ঐশ্বর্য্য লালিত। যেখানে তারা স্বপ্ন দেখে মাতৃভাষায়, ঘুম থেকে জেগে মাকে ডাকে মাতৃভাষায়। কিন্ত পাচঁ বছর বয়সে তারা যখন শিলছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, তখন যেন জীবনের সবচেয়ে বড় হোঁচট খেলো।


কারণ বিদ্যালয়ের দিদি মনি তো চাকমা ভাষায় কথা বলে না ! একটি ঐচ্ছিক বই চাকমা ভাষায়, বাকী বইগুলো তো চাকমা নয়। কিছুই বুঝে না তারা না দিদিমনির নির্দেশনা, না বইয়ের ভাষা! চাকমা ভাষায় যে বইটি রয়েছে এটিও পাড়ানো হয় মাসে ২ থেকে ৪ বার। বিদ্যালয়ে যেতে আর ভালো লাগে না তাদের। সবকিছু কেমন যেন দুর্বোধ্য!


রাঙামাটির দুর্গম জুরাছড়ি উপজেলায় আদিবাসী শিশুরা নিজস্ব মাতৃভাষায় একটি ঐচ্ছিক শিক্ষা পাঠ্য পুস্তক পেলেও কোন কাজে আসছে না। ফলে প্রশিক্ষিত শিক্ষককের অভাবের কারণে ও প্রয়োজনীয় সঠিক নির্দেশনা না থাকায় মাতৃভাষার পাঠদান কার্যক্রম মূখ থুবড়ে পড়েছে।


এমনই পরিস্থিতিতে আজ(শুক্রবার) আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে। এবছরের আদিবাসী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে“আদিবাসী ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে এগিয়ে আসুন”। ২০১৯ খ্রীষ্টাব্দকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ‘আদিবাসীদের মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক বর্ষ ঘোষণা এবং সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহনের আহ্বান জানিয়েছে।


বড়মোই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সচেতন অভিবাবক গুনবান চাকমা (৪৫), শিয়তা চাকমা (৩২) বলেন, আদিবাসী শিশুরা মাতৃভাষায় একটি বই পেয়েছে।তবে কখনো ক্লাস হয়েছে বলে তাদের জানা নেই।


বড়মোই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিরন বিজয় চাকমা বলেন, মাঝে মধ্যে মাতৃভাষার পাঠ্য বই পাড়ানো ও শেখানো হয়। তবে নিয়মিত পড়ানো হয় না বলে স্বীকার করেন তিনি।


সামিরা মূখ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিাবক কনিকা চাকমা (৩৪) ও কিরন বিকাশ চাকমা (৪০) জানান, মাতৃভাষায় আদিবাসী শিশুদের পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হয়েছে শুনেছি-বাস্তবে সব বই বাংলাই পড়া। তবে একটি মাত্র মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক ঐচ্ছিক বই দিলেও কোন দিন ছেলে মেয়েদের পাড়ানো হয়নি।


নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক শর্তে এক শিক্ষক জানান, কিছু শিক্ষকদের ১৪ দিনের স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও এটি পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া মাতৃভাষার সঠিক কোন কারিকুলাম না থাকায় এটি মূল্যায়ন কম করা হচ্ছে। যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য আদিবাসী মাতৃভাষা পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন।


উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে জুরাছড়িতে দু’ব্যাচে ত্রিশ জন করে ইতোমধ্যে ৬০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে পর্যায়ক্রমে সকল শিক্ষককে মাতৃভাষার শিক্ষা পাঠদানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।


১৪৫ নং বনযোগীছড়া মৌজার প্রবীন হেডম্যান করুনা ময় চাকমা বলেন, চার-পাঁচ দশক আগেও আদিবাসী ভাষা চর্চার এতোটা বেহাল দশা ছিলো না। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক গুরুজনই চাকমা ভাষায় নিজেদের মধ্যে চিঠিপত্র লেখালেখি করতেন। কিন্ত প্রতিযোগীতার যুগে ব্যবহারিক উপযোগিতা না থাকায় এখন ওই চর্চাটুকু সবই হারিয়ে গেছে।


উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কৌশিক চাকমা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আদিবাসীদের মাতৃভাষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সঠিক নির্দেশনা। বিভাবে বাস্তবায়ন হবে। বাংলার সাথে লিংকেজটা কখন কিভাবে হবে,যেহেতু বাংলা আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা ও অফিসিয়েল মাধ্যম। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে মল্যায়নের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন একটা নূন্যতম নাম্বারের হলেও।


জুরাছড়ি উপজেলা শিক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও ভাইস চেয়ারম্যান রিটন চাকমা বলেন, আদিবাসী শিশুরা বাসায় যে ভাষায় কথা বলছে, স্কুলে সে ভাষায় লেখাপড়া করছে না। বাংলা বুঝতে না পারার কারণে শিশুমনে পাঠ্যবই কোন দাগ কাটছে না, স্কুলের পাঠ গ্রহণ করাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে।


তিনি আরো বলেন, আদিবাসী শিশুর প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের মৌলিক অধিকার। আমরা চাই সরকার সঠিক নির্দেশনা ও কারিকোলাম মোতাবেক মাতৃভাষায় বর্ণ পরিচয়, ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট-খাটো অংক, নিজ জাতির ও বাংলাদেশের ইতিহাস শিক্ষার পাশাপাশি যেন আদিবাসী শিশু বাংলাতেও অন্যান্য পাঠ গ্রহন নিশ্চিত করা হয়। এটি শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের জন্য জরুরী।

 

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের সহকারী  জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ রবিউল হোসেন জানান,চলতি বছরে জেলার ৯৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেনীতে চাকমা,মারমা ও ত্রিপুরা শিশুদের  জন্য  ১লাখ ২৫ হাজার ৫৭টি মাতৃভাষার বই বিতরণ করা হয়েছে। ৮টি উপজেলার মধ্যে ৬টিতে ৩৬ জন করে এবং ২টি উপজেলায় ৩০ করে শিক্ষককে ১৪ দিনের জন্য মাতৃভাষা শিক্ষার উপর মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। 


বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল শাখার সাধারন সম্পাদক ইন্টু মনি তালুকদার জানান, দিবসটি উপলক্ষে রাঙামাটিতে আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন কমিটির উদ্যোগে রাঙামাটি পৌর সভায় আলোচনা সভা ও র‌্যালীর আয়োজন করেছে। আলোচনা সভা ও র‌্যালীর উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাবেক সাংসদ উষাতন তালুকদার। পরে পৌর সভা প্রাঙ্গন থেকে একটি বর্নাঢ্য র‌্যালী প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিন করে জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে গিয়ে শেষ হবে।


এদিকে দিবসটি উপলক্ষে গেল ৩ আগষ্ট রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের এক সংবাদ সন্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা) বলেছেন, এ বছর জাতিসংঘ আদিবাসীদের মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও চর্চার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। ২০১৯ খ্রীষ্টাব্দকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ‘আদিবাসীদের মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক বর্ষ’ ঘোষণা করেছে এবং সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। ইউনেস্কোর মতে,পৃথিবীতে আনুমানিক ৭০০০ভাষা এবংআদিবাসীদের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি সংখ্যা৫০০০। তার মধ্যে ২৬৮০ টি ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার আশংকার মধ্যে রয়েছে। এই বিপন্ন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভাষাগুলোই আদিবাসীদের ভাষা।

 

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের বিপন্ন ভাষাগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, পৃথিবীতে প্রায় ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ জীবিত ভাষা রয়েছে। ২০১৫ সালের এথনোলগ প্রতিবেদনে ৭,১০২টি জীবিত ভাষার উল্লেখ আছে। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশে ৪১টি ভাষার সন্ধান পেয়েছে। তারা বলেছে, সমীক্ষায় পাওয়া ভাষাগুলোর মধ্যে ১৪ টি ভাষা বিপন্ন। ভাষাগুলো হলোঃ খাড়িয়া, কোড়া, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও পাত্র।


তিনি আরো বলেছেন, জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ আদিবাসীদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। শিক্ষা নীতির ৭ নং ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “জাতি, ধর্ম, গোত্র-নির্বিশেষে আর্থ-সামাজিক শ্রেণী-বৈষম্য ও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ গড়ে তোলা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।” ২৩ নং লক্ষ্যে বলা আছে, “দেশের আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানো।”জাতীয় শিক্ষা নীতির “আদিবাসী শিশু” অনুচ্ছেদে লেখা রয়েছে, “আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষায় শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্য পুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে। এই কাজে, বিশেষ করে পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নে, আদিবাসী সমাজকে সম্পৃক্ত করা হবে। আদিবাসী প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে"।

 

তিনি আদিবাসীদের শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষা নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন ও আদিবাসী অঞ্চলের স্কুলগুলোতে অবিলম্বে বিশেষ ব্যবস্থায় আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন। 

--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত