পার্বত্য চুক্তিসহ জুম্ম জাতিসমূহের জাতীয় অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র অব্যাহতভাবে চলছে-সন্তু লারমা

Published: 01 Dec 2019   Sunday   

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা) অভিযোগ করেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর দীর্ঘ ২২ বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকার চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে।

 

তিনি  অভিযোগ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যেই সরকারের আমলে স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বর্তমানে এক নাগাড়ে ১১ বৎসর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত  থাকলেও চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর পদক্ষেপ ও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিসহ জুম্ম জাতিসমূহের জাতীয় অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। 

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ বছরপূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামজনসংহতি সমিতির উদ্যোগে ঢাকার সুন্দরবন হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে সন্তু লারমা এসব অভিযোগ করেন।

 

সংবাদ সন্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন ঐক্যন্যাপের আহ্বায়ক পংকজ ভট্টাচার্য্য, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ও আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক অধ্যাপক মেজবাহ কামাল,  যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখ। সভা সঞ্চলনা করেন সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক জলিমং মারমা।

 

সন্তু লারমা বলেন, চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার দীর্ঘ ১১ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার পরও চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে এগিয়ে না আসার কারণে জুম্ম জনগণ তথা পার্বত্য বাসীর মধ্যে একদিকে চরম হতাশা,অসন্তোষ ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অন্য দিকে নিরাপত্তহীনতা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য সঙ্কিত হয়ে পড়েছে। চুক্তি মোতাবেক বহিরাগত সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন না করে এবং পার্বত্য চুক্তি দুই তৃতীয়াংশ অবাস্তাবায়িত রেখে সরকার উল্টো ৭২ টি ধারার মধ্যে ৪৮ টি ধারা সম্পূর্ণ রুপে বাস্তাবায়িত হয়েছে বলে অব্যাহতভাবে অসত্য, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন প্রচারণা দেশে বিদেশে চালিয়ে যাচ্ছে। “চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক”, “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি শতভাগে বাস্তবায়ন করা হবে”, “চুক্তির অবশিষ্ট বিষয়সমূহ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে”মর্মে বিগত এগার বছর ধরে সরকার কেবল প্রতিশ্রুতি প্রদান করে কালক্ষেপণ করে চলেছে।

 

তিনি আরো বলেন,  সরকার জুম্ম জাতিসমূহকে চিরতরে নির্মূলীকরণে হীন উদ্দেশ্যে যুগপৎ বাঙালীকরণ ও ইসলামীকরণে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। এই উদ্দেশ্যে একই সাথে শাসকদল এবং সরকার ও সরকারের নিয়ন্ত্রনাধীন শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, প্রতিরক্ষা বিভাগের একটা বিশেষ মহল চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করা, জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করা ও চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত সকল কার্যক্রম প্রতিরোধ করার সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বোপরি ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতৃত্ব সশস্ত্র তাঁবেদার ও দালাল বাহিনীসহ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ যোগসাজশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ গ্রেপ্তার ও জেলে প্রেরণ, গুম ও প্রাণহানি, অমানুষিকনির্যাতন, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ খোঁজার নামে তিন পার্বত্য জেলায় জল পথে ও স্থল পথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্ট বসিয়ে জনগণকে নানাভাবে হয়রানিকরণ, অশালীন আচরণ, গ্রামাঞ্চলে তল্লাসী অভিযান, ধড়পাকড় ইত্যাদি জোরদার করা হয়েছে।

 

সন্তু লারমা বলেন, শান্তিপূর্ণ ও শোষণ-নিপীড়ন মুক্ত একটা নিরাপদ জীবন পাওয়ার আশায় পার্বত্যবাসীরা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে তাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল। কিন্তু দীর্ঘ ২২ বছর অপেক্ষা করেও পার্বত্যবাসীর আশা-আকাঙ্কা পূরণ করে দেওয়া হলো না। সেটি আজ পরাহত। সেটি আজ সুদূর পরাহত। এটি পার্বত্যবাসীরা কখনও ভুলতে পারে না। অগণিত মানুষের তাজা রক্ত আর অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা, অকল্পনীয় নির্যাতন, নিপীড়ন, দমন-পীড়ন, শোষণ-বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিনিময়ে অর্জিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জুম্ম জনগণ বৃথা যেতে দিতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের নীতিপরিহার করে পার্বত্য চুক্তিকে পদদলিত করে, বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, পাবর্ত্যবাসীর জমি বেদখল করে, জুম্ম জনগণকে স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, সামরিক উপায়ে দমনপীড়নের মাধ্যমে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ করে, জনসংহতি সমিতির সদস্যদের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত ও ফেরারী করে এবং নেতৃস্থানীয় সদস্যদের বন্দী ও জীবন হানি করে, জুম্ম জনগণ কেনা না মিথ্যা অভিযোগে জিম্মি করে আর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যদের সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ আখ্যা দিয়ে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের নামে যে কোন ধরনের চক্রান্ত দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না।

 

সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর বলে বিবেচনা করা যায়। এ উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব(বিশেষত রাঙামাটি ও বান্দরবান) রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদদ ও যোগসাজশে সংস্কারপন্থী খ্যাত সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন [যারা জেএসএস(এমএন লারমা) নামে পরিচয় দিতে আগ্রহী এবং দলচ্যুত আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি)(যারা মাঝে মাঝে মগ লিবারেশন পার্টি নামেও পরিচয় দিয়ে থাকে) নামক বিদেশী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আশ্রয়ও মদদ দিয়ে জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এদের দ্বারা পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অপহরণের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে আর এসব সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর দ্বারা সংঘটিত ঘটনাবলীকে দোহাই দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের উপর নির্বিচারে সেনা অভিযান, তল্লাসী ও দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনকে লঙ্ঘন করেই পার্বত্য মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ১৬ থেকে ১৭ অক্টোবর তারিখে রাঙামাটিতে আয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, হানাহানি, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজীর একতরফা অভিযোগ এনে পার্বত্য চট্টগ্রামে “সামনে ভয়ঙ্কর দিন” আসার হুমকি ও উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে। এভাবে জুম্ম জনগণের মধ্যে চরম ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করে জুম্ম জনগণের চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিকে দমন করাএবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধকরার অব্যাহত অপচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

 

জনসংহতি সমিতির তথা জুম্ম জনগণের পিঠ আজ আগের ন্যায় সম্পূর্ণভাবে দেওয়ালে ঠেকে গেছে  উল্লেখ করে সন্তু লারমা আরো বলেন, তাদের আর পেছনে যাওয়ার কোন পথ নেই। জুম্ম জনগণ ২২ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়ন অপেক্ষা করেছে। জুম্ম জনগণ সরকার তথা শাসকগোষ্ঠীকে অনেক সময় দিয়েছে। জুম্ম জনগণ সকল ক্ষেত্রে দুর্বলতর ও পশ্চাৎপদ। তাই বলে তারা অবহেলা ও উপেক্ষার পাত্র হতে পারে না। জুম্ম জনগণ অধিকারকামী ও মুক্তিকামী। আর এটাই তাদের একমাত্র সম্বল। এমনিতর ক্রান্তিকালীন পরিস্থিতিতে পার্বত্য অঞ্চলের জুম্ম জনগণ তাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর। জুম্ম জনগণ সমঅধিকার ও সমমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চায়। তাই পার্বত্য অঞ্চলে বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তারা আজ গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে তাদের করণীয় কি হতে পারে।বলাবাহুল্য পার্বত্য অঞ্চলের বুকে আজ দুটি পক্ষ পরস্পরেমুখোমুখী অবস্থানে দন্ডায়মান। একপক্ষ চুক্তি বাস্তবায়ন চায় আর অন্যপক্ষ চুক্তি পদদলিত করতে উদ্যত। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন ছাড়া পার্বত্য সমস্যার সমাধানের আর কোন বিকল্প নেই।

 

ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য্য বলেন, আদিবাসীদেরকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিয়ে এই রাষ্ট্র উদার রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না। যে চুক্তি ২২ বছর আগে করা হয়ে ছিলো সে চুক্তি এত বছর পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা ছাড়া কিছ ুনয়। তিনি অতি দ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত