স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের পরিপত্রে পার্বত্যাঞ্চলের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার খর্বের মাধ্যমে সংবিধান লংঘন করা হয়েছে

Published: 24 Aug 2015   Monday   

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশী নাগরিকদের ভ্রমন ও ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীদের সাথে দেশী-বিদেশী সংস্থা কিংবা ব্যক্তিদের বৈঠক সংক্রান্ত বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জারীকৃত পরিপত্রের মাধ্যমে এ অঞ্চলের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার খর্ব ও সংবিধান লংঘন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন।

নেতৃবৃন্দ এ পরিপত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্য করা হচ্ছে, যা সংবিধানের ২৮(১) ধারার পরিপন্থী উল্লেখ করে অবিলম্বে এ পরিরপত্র প্রত্যাহার করা না হলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যাওয়ার পাশাপাশি উচ্চতর আদালতে আশ্রয় নেয়া হবে।

গতকাল সোমবার রাঙামাটি শহরের স্থানীয় একটি রেষ্টুরেন্টে আয়োজিত এক সংবাদ সন্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ানের সভাপতিত্বে অন্যান্যর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর মংসানু চৌধুরী, আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, এমএন লারমা মোমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা ও নারী নেত্রী শেফালিকা ত্রিপুরা। সংবাদ সন্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পাঠ করেন নারী নেত্রী টুকু তালুকদার। সংবাদ সন্মেলনে এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দসহ এনজিও সংস্থার কর্মকর্তা,ব্যবসায়ী, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। এসময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন নেতৃবৃন্দ।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়েছে। চুক্তি পরবর্তীতে আইনশৃংখলাসহ পার্বত্যাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ায় তৎকালীন সরকার বিদেশী নাগরিকদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে আরোপিত বাধা-নিষেধও শিথিল করে। পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং সেখানে বিদেশী নাগরিকদের ভ্রমণ সহজতর করার লক্ষ্যে তাদের ভ্রমণের অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের নিকট ন্যস্ত করা হয়। এত বছর ধরে তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকরা বিদেশী নাগরিকদের ভ্রমণের অনুমতি দিয়ে আসছেন। এখন দেড় যুগের অধিক সময় পার হয়ে এসে হঠাৎ এমন কী নিরাপত্তা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে, এই ক্ষমতা জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে নিতে হবে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন এরকম পশ্চাৎমুখী সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা তাদের কাছে বোধগম্য নয়। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যবিবরণীতে ‘নিরাপত্তার’ কথা বলা হয়েছে। আমাদের পর্যবেক্ষণ মতে দেশের অপরাপর জেলার তুলনায় পার্বত্য অঞ্চলের আইন শৃংখলার পরিস্থিতি অনেক ভালো। তারপরও বলতে চাই, বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্যে কোন বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত বা নীতিমালা গ্রহণ করার প্রয়োজন হলে স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান ও প্রথাগত নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে তা করা জরুরী।

সংবাদ সন্মেলনে বলা হয়, এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮-এর ৫৩ ধারা অনুসারে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কোন আইন অথবা অন্য কোন আইন যা পার্বত্য অঞ্চলের জন্যে অসুবিধাজনক হতে পারে সে রকম কোন আইন প্রণয়নের প্রাক্কালে পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে আলোচনা এবং পরিষদের পরামর্শ বিবেচনা করতে বাধ্য। যে কোন বিধি, প্রবিধান এবং আদেশ প্রণয়নের ক্ষেত্রেও আইনটি প্রযোজ্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক এই একতরফাভাবে গৃহীত পরিপত্রের মাধ্যমে উপরোক্ত আইনটিরও লংঘন করা হয়েছে, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মত দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে আশা করা যায় না।

সংবাদ সন্মেলনে আরও বলা হয়, গত ৭ জানুয়ারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে সভায় গৃহীত ১১ দফা সিদ্ধান্তের মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক হওয়ায় দেশের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রবল আপত্তি ও প্রতিবাদ করেন। তবে গত ২২ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সভায় পূর্ববর্তী সভার কিছু সিদ্ধান্ত সংশোধনী আনা হলেও তাতে বিষয়বস্তুর কোন গুণগত পরিবর্তন  করা হয়নি।

নেতৃবৃন্দ বলেন, পার্বত্য চুক্তি ১৯৯৭ এবং এর আলোকে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮-এ পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘উপজাতীয় অধ্যূষিত অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এবং এই এলাকার সার্বিক উন্নয়নে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘উপজাতীয় অধ্যূষিত অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার অন্যতম মূল চেতনা হলো জাতীয় পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানসমূহের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তাদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
নেতৃবৃন্দ পার্বত্যাঞ্চলের নাগরিকদের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার অক্ষুন্ন রাখা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিন দফা জানান। সেগুলো হল বিদেশী নাগরিকদের পার্বত্যাঞ্চলে ভ্রমণ, দেশী-বিদেশী ব্যক্তি/সংস্থা কর্তৃক পার্বত্যাঞ্চলে স্থানীয় নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাথে সাক্ষাৎ/বৈঠক’ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈষম্যমূলক পরিপত্র অবিলম্বে প্রত্যাহার, বিদেশী পর্যটক ও উন্নয়ন সহযোগীসহ পার্বত্যাঞ্চলের কোন অধিবাসীর বিদেশী বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজন পার্বত্যাঞ্চলে আসতে চাইলে তাদের ভ্রমণের অনুমতি প্রদানের বিষয়টি পূর্বের ন্যায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের নিকট ন্যস্ত করা এবং পার্বত্যাঞ্চলে বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে পার্বত্য মন্ত্রণালয়, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, তিন সার্কেল চীফ, জেলা প্রশাসক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ গ্রহন করতে হবে।

সংবাদ সন্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এ ধরনের সংবিধান পরিপন্থী সিদ্ধান্ত আমরা কোন দিনই মেনে নিতে পারবো না। সংবিধানের দেশের একজন নাগরিক হিসেবে যে মৌলিক অধিকার রয়েছে তা এর মাধ্যমে খর্ব করা হয়েছে। তিনি অবিলম্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জারি করা পরিত্র প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেন, দেশের নাগরিক হিসেবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অধিকার রয়েছে। সরকার যদি এ পরিপত্র প্রত্যাহার না করে তাহলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি উচ্চতর আদালতে আশ্রয় নেয়া হবে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

 

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত