পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সংসদ মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার(এমএন লারমা) ৩২তম মৃত্যূ বার্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার রাঙামাটিতে শোক র্যালী ও স্মরণ সভাসহ নানান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
স্মরণ সভায় বক্তারা এমএন লারমার স্বপ্ন, আদর্শ ও চেতনাকে বুকে ধারন করে জুম্ম জনগনের আত্ননিয়ন্ত্রনাধিকার অধিকারের সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জেলা শাখার উদ্যোগে জেলা শিল্পকলা একাডেমী মিলায়নাতনে আয়োজিত স্মরণ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন রাঙামাটি আসনের নির্বাচিত সাংসদ উষাতন তালুকদার। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জেলা শাখার সভাপতি সূবর্ণ চাকমার সভাপতিত্বে অন্যান্যর মধ্যে বক্তব্যে রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য মাধবীলতা চাকমা, এমএন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, সাংস্কৃতি কর্মী শিশির চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির জেলা শাখার সাধারন সম্পাদক অরুন ত্রিপুরা। শুরুতে স্মরণ সভায় শোক প্রস্তাব পাঠ করে শুনান পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি ত্রিজিনাদ চাকমা। এরপর এমএন লারমাসহ অন্যান্য নিহতদের স্মরণে দাড়িয়ে দু’মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এছাড়া সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্জ্বল ও ফানুস বাতি উড়ানো হয়।
এর আগে একটি প্রভাতফেরী জেলা শিল্পকলা একাডেমী চত্বর থেকে শুরু হয়ে বনরুপা ঘুরে গিয়ে আবারও শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। পরে শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে অস্থায়ীভাবে শহীদ বেদীতে জনসংহতি সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পমাল্য অপর্ণ করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাংসদ উষাতন তালুকদার বলেন, পার্বত্য চুক্তি কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না তার বাস্তবতা হল ক্ষমতাসীন দলের শতকরা ৯০ শতাংশ হচ্ছে সাংসদ। তারা শ্রমিক-কৃষক মেহনতি আদিবাসী মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবেন না। তারা ধনী শ্রেনীর স্বার্থ করবেন।
তিনি আরও বলেন, যারা ক্ষমতায় বা রাষ্ট্র পরিচারনা করেন তাদের মধ্যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে উগ্রজাতীয়তা মানসিকতা বিরাজমান। যার কারণে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর রয়েছে তাদের বিষয়ে একটা উদার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসার লোকজনের অভাব পরিলক্ষিত হওয়ার কারণে আজকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমরা শিক্ষা বিপক্ষে নয়, সাধারন অর্থে মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হবে সেটা ভাল কথা, তা হওয়া উচিত। তবে কি কারণে এখানকার মানুষ মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চাই না, অপাতত এ সময়ে কেন চাই না সেই বিষয়টি উপলব্দি ও অনুধাবন করতে হবে। এ সরকারের কেন এত দরদ যে মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জোর করে দিতে হবে। যে বিশ্ববিদ্যালয় না দিলে হয় না। তা জোর করে দিতে হবে, না দিলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে? মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় না দিলে বাংলাদেশের মহা ক্ষতি হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষতি হবে? কেন চাপিয়ে লুকিয়ে গোপণে বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ধোধন করতে হবে? কি স্বার্থ, কার স্বার্থে কিসের স্বার্থ জড়তি রয়েছে যে জোর করে শিক্ষা দিতে হবে, এটা কি ধরনের মানসিকতা। অথচ দুর্গম এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কি অবস্থায় বিরাজ করছে যেখানে শিক্ষক নেই, শিক্ষার্থীরা ঠিকমত স্কুলে যেতে পারে না এসব বিষয়ে দেখার কেউই নেই।
তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য বলেন, আপনি আপনার নিজস্ব লোক দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখুন। পাহাড়ের মানুষ আপনার সাথে মতের বিরোধে জড়িত হতে চায় না। মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে লংকাকান্ড করতে চায় না। এখানকার মানুষের, অনুভূতি,বেদনা বাস্তবতাকে অনুধাবন করুন। আপনি আপনার নিজস্ব লোক দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখুন। শান্তিপুর্ণ উপায়ে সুরাহা করাই হল উত্তম।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে পার্বত্য চুক্তির অন্যতম প্রতিষ্ঠান পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ জেলা পরিষদ, নির্বাচিত সাংসদ, জনপ্রতিনিধি ও জ্ঞানী-গুনিজনের সাথে কোন প্রকার আলাপ-আলোচনা করা হয়নি। চুপিসারে গোপনে মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কেন করা হবে? এখানে কাউকে পাস কাটিয়ে কাউকে এড়িয়ে বাংলাদেশে কোন কিছুই করা যাবে না। তা বুঝতে হবে।
পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি উল্লেখ করে উষাতন তালুকদারএমপি বলেন, আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ সৃষ্টি করে সরকারের কি লাভ হয়েছে? মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য, নাকি লোভ দেখানোর জন্য? জেলা পরিষদকে ঘুষ নিয়ে শুধু দুএকটা শিক্ষককের চাকুরী দেয়ার জন্য ও গম চাউল ভাগ করার জন্য বসে রাখা হয়েছে আর আঞ্চলিক পরিষদকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করতে হবে। সাধারন প্রশাসন এখন জেলা প্রশাসক এবং আইন-শৃংখলা ও স্থানীয় পুলিশ পুলিশ সুপার নিয়ন্ত্রন করে থাকেন। সাধারন প্রশাসন এবং আইন-শৃংখলা ও স্থানীয় পুলিশ জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। তাই এ সাধারন প্রশাসন, আইন-শৃংখলা, স্থানীয় পুলিশ যতক্ষন পর্ষন্ত হস্তান্তর করা না হবে ততক্ষন পর্ষন্ত জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ যে উদ্দেশ্য গঠিত হয়েছে সেটার পরিপূরণ হবে না, ক্ষমতায়ন হবে না। ক্ষমতায়ন না হলে তা অকার্যকর হয়ে নিধিরাম সরদার হয়ে থাকবে।
তিনি ছাত্র ও যুব সমাজকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মহান নেতা এমএন লারমা সত্যিকারভাবে একজন দেশ প্রেমিক, অকুতভয়, দুরদর্শী, দার্শনিক, কর্মদক্ষ, সৎসাহসী ও অত্যন্ত সুশৃংখল আদর্শরে মানুষ ছিলেন। তিনি মহান নেতার স্বপ্ন, আদর্শ ও চেতনাকে সত্যিকারভাবে বুকে ধারন করে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য,১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়ির গভীর জঙ্গলের এক গোপন আস্তানায় জনসংহতি সমিতির বিভেদপন্থী গ্রুপের সশস্ত্র হামলায় এমএন লারমা তার ৮জন সহযোদ্ধাসহ নির্মমভাবে নিহত হন।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.