পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা) অভিযোগ করে বলেছেন,বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার পার্বত্য চুক্তির ১৮ বছর অতিবাহিত হলেও চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন করছে না। বরং তার পরিবর্তে পার্বত্যাঞ্চলের জুম্ম জনগনের অস্তিত্ব বিলুপ্তির জন্য যা যা কিছু করার তাই করে যাচ্ছে।
সরকার যে ব্যবস্থা গ্রহন করেছে তা শ্লো-পয়জনিং-এর মত ধীরে ধীরে জুম্মজনগণ তাদের সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে ও জীবনধারা থেকে বিচ্ছুত হতে বাধ্য হচ্ছে।
শনিবার রাঙামাটিতে দুদিন ব্যাপী প্রথাগত সামাজি প্রধান হেডম্যানদের দুদিন ব্যাপী সন্মেলনের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা এ কথা বলেন।
রাঙামাটি সাংস্কৃতিক ইনস্টিউিট মিলনায়তনে সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, এএলআরডি ও কাপেং ফাউন্ডেশনের সহায়তায় দুদিন ব্যাপী পার্বত্য চট্টগ্রাম হেডম্যান সন্মেলনের উদ্ধোধন করেন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়। সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সভাপতি কংজরী চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা,এএলআরডির উপ-পরিচালক রওশন জাহান মনি,কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা। স্বাগত বক্তব্যে রাখেন সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সাধারন সম্পাদক শান্তি বিজয় চাকমা।
দুদ্যিবাপী সন্মেলনে তিন পার্বত্য জেলার চাকমা, মং ও বোমাং সার্কেল থেকে প্রায় দুই শতাধিক হেডম্যান অংশ নেন।
সন্তু লারমা আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে বাস্তবতা আমরা হারিয়ে যাচ্ছি, আমাদের পায়ের তলায় মাটি নেই, মাথার ওপর আকাশ নেই, নিঃশ্বাস ফেলতে পারি না, শ্বাসরুদ্ধকর জীবন নিয়ে আমাদেরকে অতিবাহিত করতে হচ্ছে।
তিনি অভিযোগ করেন, দীর্ঘ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে সেনা শাসন চলছে। এখানে একজন সিপাহী একজন আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের চেয়ে ক্ষমতাবান। পার্বত্য চুক্তি অনুয়ায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে কোন ক্ষমতা না দিয়ে ধনীর ঘরে গ্রীন রুমে শোফিস-এর মত রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রমে যে নিরাপত্তাহীন জীবন, ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসযুক্ত যে জীবন। এই জীবন নিয়ে কি বেঁচে থাকবো। সেটা হতে পারে না। তাই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবাইকে আরও অধিকতর সংগ্রামী হয়ে জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রাখতে ও অধিকারের জন্য জোরালোভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, অচিরেই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করতে না পারি তাহলে আগামীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটা ভয়াবহ বাস্তবতা আমাদের সামনে হাজির হবে। এ বাস্তবতা আমরা জানি না কোথায় গিয়ে কিভাবে আমাদের জীবনকে খুজে পাবো। সেটা অামি জানি না।
তিনি হেডম্যানদের চুক্তি বাস্তবায়নের এগিয়ে আসার উচিত মন্তব্য করে বলেন,হেডম্যানরা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন সংগ্রামে এগিয়ে এসে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তোলেন তাহলে সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হবে না কেন।
সন্মেলনে বোমাং ও মং সার্কেলের চীফ উপস্থিত না থাকায় দুঃখজনক উল্লেখ করে সন্তু লারমা বলেন, তথাকথিত মান-মর্যাদা টানাপোড়েনের কারণে আজকে তিন সার্কেল চীফের মধ্যে দুই সার্কেল চীফ এ সমন্মেলনে উপস্থিত হননি। যদি তারা উপস্থিত থাকতেন তাহলে এখানকার বিষেয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা করে অনেক এগিয়ে নেয়া সম্ভব হতো।
এটা আমাদের জন্য দুঃভাগ্য, জাতীয় নেতৃত্বের দন্যতা, হীনমন্যতা এবং তথাকথিত সমান্ততান্ত্রিক, প্রতিক্রিয়াশীল সুবিধাবাদী একটা চিন্তাধারার প্রতিফলন। যে প্রতিফলন আমাদেরকে কোন উৎসাহিত করতে পারে না, আনন্দ দিতে পারে না ও সর্বোপরী সংগ্রামী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না। বরংশ এখানে দ্বিধাদ্বন্ধ জর্জরিত ও সমাজের দ্বিধাদ্বন্ধের সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, যাদেরকে উদ্দেশ্য নিয়ে এখানকার অধিবাসীরা আকাংখা, স্বপ্ন দেখেসেই সার্কেল চীফের এ ধরনের হীনমন্যতা ভুগেন, দ্বিধাদ্বন্ধে থাকেন তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান যে পরিস্থিতি জুম্ম জনগণের কোন নিরাপত্তা নেই। ধীরে ধীরে মৃত্যু ও বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছি। সেটা যদি সার্কেল চীফরা বুঝতে না পারেন তাহলে তাদের দায়িত্বে না থাকাই যুক্তসংগত বলে আমি মনে করি।
সমান্তান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারায় যে সার্কেল চীফ,হেডম্যান কারবারীরা ধারাবাহিকভাবে বহন করছেন সেখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে না পারেন তাহলে পার্বত্য চুক্তির বদৌলতে যে বিশেষ শাসন ব্যবস্থা,যে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি সেখানে তারা কিভাবে সামিল হবেন সম্পৃক্ত হবেন এই বিষয়টি সবচেয়ে জরুরী বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন,এ সন্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে শতকরা ৮০ভাগ হেডম্যানদের উপস্থিতি কামনা করা হলেও এ সন্মেলনে অধেকাংশ উপস্থিত নেই। এ থেকে বুঝা যায় হেডম্যানরা পিছিয়ে রয়েছেন, পশ্চাদমুখী রয়েছেন। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নতি চান না। পার্বত্য চট্টগ্রামের যে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে বিশেষ অধিকার তা তারা চান না।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, বান্দরবানের ক্ষমতাসীন দলের বাইরে কেউই কিছুই করতে পারে না। সেখানে প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈ হ্লা আওয়ামীলীগ করেন। এমনতর আওয়ামীলীগ করেন যে সেখানে তারা জুম্ম জনগনের অস্তিত্বের কথা চিন্তাভাবনা করেন না। পাশাপাশি পার্বত্য চুক্তি জুম্ম জনগণের স্বার্থ সংরক্ষনের জন্য যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই অস্তিত্ব সংরক্ষনের কথা তারা স্বীকার করেন না।
সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নে বিশেষ এজেন্ডা রয়েছে। উন্নয়ন বলতে কালভার্ট, বিল্ডিং রাস্তাঘাট নির্মাণ করা নিঃসন্দেহে তা নয়। এখানে উন্নয়নের প্রধান বিষয় আইন-শৃংখলাকে উন্নয়নে এনে যথাযথ গণমুখী শাসন ব্যবস্থা ও গণমুখী অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতার আলোকে হেডম্যান ও জনপ্রতিনিধিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য অধিকতর আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.