প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়নে সব পক্ষকে এক সাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন,তাঁর সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেবলমাত্র ভূমি কমিশনের সংস্কার ব্যতীত পার্বত্য শান্তি চুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী চারটি ব্রিগেড ব্যতীত অধিকাংশ সেনা ক্যাম্পও সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেনা ক্যাম্পগুলো অধিকাংশ’ই তুলে নেয়া হয়েছে। যা সামান্য কিছু আছে- চারটি জায়গায় কেবল ৪টি ব্রিগেড থাকবে। বাকীগুলো পর্যায়ক্রমে সব সরিয়ে নেয়া হবে। যে জন্য রামুতে আমরা একটা সেনানিবাস করেছি।
তিনি আরো বলেন, সরকার ভূমি সংস্কারের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন একাধিকবার গঠন করলেও কমিশনের কাজ সন্তোষজনকভাবে এগোয়নি। কারণ সেখানে কিছুটা অবিশ্বাস এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন।
রোববার সকালে রাজধানীর বেইলী রোডে দুই একর জমির ওপর পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণের ভিত্তিফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্যে রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ কমিটির আহবায়ক এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এমপি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যেতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা),পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। আলোচনা সভা শুরুর আগে প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদবর্গ, সাংসদ সদস্যগণ, সামরিক-বেসমারিক উর্দ্ধতন কর্মকর্তাসহ তিন পার্বত্য জেলা থেকে সুধীজনরা অংশ গ্রহন করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘চিটাগং হিল ট্রাক্টস: লং ওয়াক টগ পিস অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠান শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন-২০০১ এর কতিপয় সংশোধনীর বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে সম্ভব সবকিছু করতেই সরকার প্রস্তুত রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরাও বাংলাদেশের নাগরিক। সুতরাং সরকার ঐ অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ,বিদ্যুৎ খাত এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহন করেছে।
তিনি বলেন, পাহাড়ের জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নে তার সরকার রাঙামাটিতে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রত্যন্ত এলাকায় আবাসিক সুবিধাসহ বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্থাপনেরও পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ইতোমধ্যে নতুন উপজেলা গুইমাড়া, নতুন থানা সাজেক এবং নতুন ইউনিয়ন বড়থলি গঠন করেছি। গত ২০০৯-১৪ সালে তাঁর সরকারের সময়ই সার্কেল চিফের সম্মানী এক হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা, হেডম্যানদের সম্মানী ১০০ থেকে ১ হাজার টাকায় উন্নীত করা এবং কারবারিদের জন্য ৫০০ টাকা সম্মানী চালু করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক কষ্টে এই জায়গাটা উদ্ধার করে অবশেষে কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এবং এটা আমার কাছে নির্দিষ্ট ছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি, তাদের জীবনমান সবকিছুর যেন প্রতিফলন ঘটে। তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে দ্রুত কমপ্লেক্সের কাজ শেষ করার তাগিদ দিয়ে দরকার হলে ডাবল শিফটে কাজ করার নিদের্শ দেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেন, আজকের এ দিনটি পার্বত্যবাসীদের জন্য একটি শূভ দিন, একটি শুভ মহুর্ত, একটা আনন্দঘন পরিবেশে এ মহতি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটি পার্বত্য অধিবাসীদের নতুন করে আশা-অকাংখার সঞ্চার করবে। কিন্তু তা সত্বেও একটা প্রশ্ন আসতে পারে আজকের এ আয়োজন ও পরিবেশ পার্বতাাঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতি কতটুকু সংহতিপূর্ন। কারণ পার্বত্য অঞ্চলের বিাজমান পরিস্থিতি কোন অবস্থাতে সুখদায়ক ও আশাব্যঞ্জক নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সুষ্ঠ সমাধানের লক্ষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে উল্লেখ তিনি আরো বলেন,। দীর্ঘ ১৮ বছর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্যাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল উদ্বেগজনক ও হতাশা ব্যঞ্জক এবং অবিশ্বাস সন্দেহ দুরত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পার্বত্যবাসীদের মনে হতাশা ও নিরাশা চেপে বসেছে। নিরাপত্তাহীন ও অশ্চিত ভবিষ্যত ভাবনায় তারা আজ বিপর্যস্থ। জাতীয় স্বার্থে এ বিষয়টি গভীরভাবে বিচেনার জন্য তিনি দাবী রাখেন।
সন্তু লারমা বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষন নেতৃত্বে যেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নিমার্ণ সম্ভব হলো তেমনি প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যবলীর সকল দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমুহ নির্বাহী আদেশে হস্তান্তরকরণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কমপ্লেক্স নির্মাণ, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সংশ্লিষ্ট আইনসমুহ সংশোধনসহ পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হতে পারে।
জানা গেছে প্রায় দুই একর জমির ওপর নির্মাণা হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের ৬ তলা ভবন,মাল্টি পারপাস হল, ডরমেটরী, প্রশাসনিক ভবন, জাদুঘর, লাইব্রেরী, ডিসপ্লে সেন্টার, থিয়েটার হল, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর বাস ভবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের বাসভবন থাকবে।
সূত্র আরো জানায়, এ পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স-এর স্থাপনের মধ্য দিয়ে পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন ক্ষু-নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সামাজিক রীতি-নীতি, ভাষা, ধর্ম এবং আচরণগত স্বাতন্ত্রতা সম্পর্কে দেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলা হবে। পাশাপাশি কমপ্লেক্সটি পর্যটকদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির সমন্বয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক স্থাপনা হিসেবেও বিবেচিত হবে। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের সাথে সমতলের মানুষের পারস্পরিক সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, সহযোগিতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন তৈরিতে কমপ্লেক্সটি অগ্রনী ভূমিকা পালন করবে।
উল্রেখ্য, ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক-এ পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্- শীর্ষক প্রকল্পটি সরকারের মধ্য মেয়াদী বাজেটের অন্তর্ভূক্ত করে অনুমোদিত হয়। প্রায় ১০৬ কোটি টাকার ব্যয়ে নির্মিত এ পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লক্সে নির্মাণ করছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়। আগামী ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.