লামার ২৭টি ইটভাটায় প্রকাশ্যে বনের গাছ পুড়ানো ও পাহাড় কাটার অভিযোগ

Published: 17 Jan 2018   Wednesday   

বনের গাছ আর পাহাড়ের মাটি কেটে চারপাশের পরিবেশ দূষণের মধ্যে ফেলে কোনো ধরনের লাইসেন্স না নিয়ে পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় দেরারছে চলছে ২৭টি ইটভাটায় ড্রাম চিমনি ও পাকা চিমনির  ইটভাটার কার্যক্রম । নীতিমালা লঙ্ঘন করে বনের মাঝে ও লোকালয় ও কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে।

 

 লামা উপজেলা নির্বাহী কার্যালয় সূত্রে  জানা যায়,  লামা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে মোট ২৬টি ইট ভাটা যে এলাকায় অবস্থিত যথাক্রমে-  ফাইতং ইউনিয়নের রাম্য খোলা এলাকায় এস.বি.এম ব্রিকস , এফ.বি.এম ব্রিকস, এ.বি.এম ব্রিকস, এম.বি.আই ব্রিকস, পি.বি.সি ব্রিকস, এম.বি.এম ব্রিকস, বি.বি.সি ব্রিকস, শিবাতলী পাড়ায় এ.বি.সি ব্রিকস(১), এইচ.বি.এম ব্রিকস, এ.বি.সি ব্রিকস(২), কুইজ্যা খোলায় এলাকায় টি.এইচ.বি ব্রিকস, পি.বি.এম ব্রিকস, হরিন খাইয়া এলাকায় এস.এ.বি ব্রিকস, ইউ.বি.এম(১) ব্রিকস, ইউ.বি.এম(২) ব্রিকস, বি.বি.এম ব্রিকস, বড় বিল এলাকায় এফ.এ.সি ব্রিকস, এস.বি.ডব্লিউ ব্রিকস, বাঙ্গালী পাড়ায় ই.বি.এম ব্রিকস আর ফাদুু ছড়ায় এ.বি.এম ব্রিকস, এম.আই.বি ব্রিকসসহ ২১টি ইটভাটা। এ ছাড়া ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কাঠাল ছড়া এলাকায় কে.সি.বি ব্রিকস, মালুম্যা এলাকায় এম.এস.বি ব্রিকস, হারগাজা এলাকায় এইচ.বি ব্রিকস, রইগ্যা এলাকায় কে.বি.সি, গজালিয়া ইউনিয়নের ব্রিকফিল্ড এলাকায় পি.বি.এম ব্রিকস এবং লামা পৌরসভায় এস.বি.এম ব্রিকসসহ মোট ২৭ টি ইটভাটা রয়েছে।

 

লামা সদর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে ফাইতংয়ের ইটভাটা গুলো সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ২১টি  ইট ভাটায়  ইট তৈরী করতে চুল্লিতে ভরছে বনের গাছ। জ্বালানী হিসাবে বনের গাছ কেটে সারি বদ্ধ ভাবে স্তুপ করে রেখেছে এবং পাহাড় কেটে চুল্লির পাশে মাটি পাহাড় সমান স্তুপ করে রাখা হয়েছে। এ সব ইট ভাটায় মাটি কাটার জন্য প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছে বোলডোজার আর স্ক্যাভেটর (মাটি কাটার যন্ত্র)। ইট ভাটায় কর্মরত ম্যানাজারের মাধ্যমে জানাযায়, গত ২০ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্য ইটভাটায় ইট পুড়ানো শুরু করেছে। রবিবার দুপুর দেড়টায় সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকল ইট ভাটার চুল্লি দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।  ইট ভাটায় বনের গাছ দিয়ে ইট পোড়াচ্ছে। চুল্লির গোড়ায় সারিবদ্ধ ভাবে বনের গাছ সাজিয়ে রেখেছে। আর এ ইটাভাটার মাঠে লক্ষ লক্ষ কাঁচা ইট বানিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। পাহাড় থেকে মাটি কেটে এনে পাহাড়ের মতো করে মাটি স্তুপ করে রেখেছে।

 

অভিযোগে জানা যায়,চারপাশে পাহাড় বেষ্টিত ৭টি আদিবাসী পাড়া ঘিরে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটারের ভিতর লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নেই গড়ে তুলেছে ২১টি ইট ভাটা। এ ছাড়া লামা পৌরসভার ছাগল খাইয়া এলাকায় ১টি, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ৪টি ও গজালিয়া ইউনিয়নে ১টি ইটভাটা। প্রতিবছরের মতো এবারও বন উজাড় আর পাহাড় কেটে  ইটভাটায় ইট তৈরী করছে।  মাটির স্তুুপ করাসহ  জ্বালানীর জন্য বনের গাছ পুড়াচ্ছে ।

 

ইবিসি ইট ভাটার ম্যানাজার মোঃ জোনায়েতের জানান, গেল ১৯ নভেম্বর ইটভাটা আগুন দিয়ে ইট পুড়ানোর কাজ শুরু করেছি। প্রথম রাউন্ডে ইটভাটার ভিতর ৫ লক্ষ ইট দিয়েছি। আল্লাহ সহায় থাকলে এ বছর ৭ থেকে ৮ রাউন্ড ইট অর্থাৎ প্রায় ৪০লক্ষ ইট বাহির করতে পারবে বলে তিনি জানান। জ্বালানীর জন্য কয়লা নাকি লাকড়ী ব্যবহার করছেন একপ্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা পাহাড়ের গাছ ওও লাকড়ী ব্যবহার করে থাকি। কয়লা দিয়ে ইট পুড়ালে ব্যয় বেশী হয়। প্রতি রাউন্ডে কি পরিমান জ্বালানী কাঠের প্রয়োজন হয় জানতে চাইলে ম্যানাজার উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান।

 

এ দিকে ইট ভাটার মালিকদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা জানিয়েছেন,  তাদের সকলের পক্ষে কথা বলার জন্য ফাইতং ইটভাটার মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ কবির আহম্মদ নিয়োজিত রয়েছেন। তারা তার সাথে কথা বলতে বলেন।

ফাইতং ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি কবির আহম্মদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, লক্ষ লক্ষ টাকা পুঁজি খাটিয়ে ইটভাটার মালিকরা ইটের ব্যবসা করছে। তাদের সকলের সাথে যোগাযোগ করে প্রতি বছর ইটভাটা করে থাকি। তারা ১৩ টি ইট ভাটার জন্য হাই কোর্টে রিট করেছি। অন্য গুলোও এ প্রক্রিয়ায় রয়েছে। কোন কোন ইট ভাটার মালিক রিট করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ তথ্য গুলো আপনাদের(সাংবাদিক) দেয়া যাবে না বলে মুঠোফোনটি কেটে দেন।

 

এ দিকে ৩০৬ নং ফাইতং মৌজার হেডম্যান বাবু উম্রা মং মার্মা  জানান, উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৫০থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের ভিতর অবস্থিত উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের হেডম্যান পাড়ার আশেপাশে প্রায় ১৫ কিলোমিটারের ভিতর গড়ে উঠেছে এ সব ইট ভাটা। এ দূরত্বের মধ্যে আমাদের উপজাতি সম্প্রদায়ের ৭ পাড়ার প্রায় ৪০৪ পরিবারের লোকজন বসবাস করে।  ইট ভাটার কারণে আমাদের লোকজনের নানান সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পাড়ার নিরাপত্তাসহ মেয়েরা অবাধে চলা ফেরা করতে পারে না।  মার্মা সম্প্রদায়ের প্রায়  ৮০ শতাংশ লোকজন জুম চাষ আর পাহাড় থেকে খাদ্য সংগ্রহ ও ঘরের রান্নার জ্বালানী পাহাড় থেকে এনে চলতো। পাহাড় গুলো ইটভাটার কারণে ন্যাড়া হয়ে গেছে।  এছাড়া ইট ভাটার পাশে আমার ১৪ বছর বয়সি ১০ একর আয়তনের একটি আমের বাগানসহ এলাকার আরো অনেক মানুষের এ রকম ফলজ বাগান রয়েছে। কোন বাগানেই এ পর্যন্ত কোন ফল ধরেনি। এর কারণ হিসাবে সবাই বলছে, ইটভাটা গুলোর কারণে এলাকার পরিবেশ  দূষিত হয়ে পড়ায় এ সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি।

 

লামা নির্বাহী কর্মকর্তার ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভূমি) মোঃ সায়েদ ইকবাল বলেন, লামায় কোন ইট ভাটার বৈধ কোন কাগজ পত্র নেই। সব ইট ভাটা অবৈধ ভাবে গড়ে উঠেছে। উপজেলা প্রশাসন এ অবৈধ ইটভাটা বন্ধে তৎপর রয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ইতিমধ্য কয়েকটি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে মাটি কাটার অপরাধে জরিমানা করেছে। লামা উপজেলায় কয়টি ইটভাটা রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে ২১ টি, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ৪ টি, গজালিয়া ইউনিয়নে ১টি আর লামা পৌরসভায় ১টি ইটভাটা রয়েছে।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ জালাল উদ্দিন কোম্পানী বলেন, যত্রতত্র ভাবে ইটভাটা গড়ে উঠায় তার ইউনিয়নে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানান। ইটভাটার মালিকরা ইউনিয়ন পরিষদের কোন আইন কানুন মানেনা। গায়ের জোরে সব কাজ করে। প্রতিদিন ২শত থেকে আড়াইশত ছোট-বড় ট্রাক দিয়ে ইট পরিবহনের দায়ে সরকারী অর্থায়নে নির্মিত সকল রাস্তা গুলো ভেঙ্গে গেছে। ইউনিয়ন পরিষদকে একটাও ট্যাক্স দেয়না।

লামা থানার ভারপ্রাপ্ত(ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিভাগের। তবে কোনো বিভাগ পুলিশের সহযোগিতা চাইলে তা দেওয়া হবে।

 

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্রগ্রাম বিভাগের পরিচালক মোঃ মকবুল হোসেনও অপরিকল্পিত গড়ে উঠা ইটভাটা গুলো পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে স্বীকার করে বলেন, বান্দরবান জেলায় সবচেয়ে ইটভাটা গড়ে উঠেছে লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিনে। ঐ এলাকায় বসবাসের দিন দিন উপযুক্ততা হারাচ্ছে। তবে বান্দরবান জেলা দেখাশুনা করে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর।

 

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার অঞ্চলের পরিচালক সাইফুল আসশ্রাবের মুঠোফোনে যোগাযোগ করার জন্য গত ১৫ জানুয়ারী বারবার কল দিয়েও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

 

বান্দরবান জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বনিক বলেন, লামা উপজেলায় গড়ে উঠা ইটভাটা করার কোন লাইসেন্স নেই। গড়ে উঠা ইটভাটাগুলো অবৈধ ভাবে গড়ে উঠেছে। এ ইটভাটা গুলো বন্ধে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করবে।

--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.

উপদেষ্টা সম্পাদক : সুনীল কান্তি দে
সম্পাদক : সত্রং চাকমা

মোহাম্মদীয়া মার্কেট, কাটা পাহাড় লেন, বনরুপা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
ইমেইল : info@hillbd24.com
সকল স্বত্ব hillbd24.com কর্তৃক সংরক্ষিত