২০২৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৪০টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে এবং এসব ঘটনায় ১ হাজার ৬৮৭ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। এছাড়াও ৬৪টি গ্রাম এক বা একাধিক বার আইন-শৃংখলা বাহিনীর অভিযানের শিকার এবং ৮৪টি বাড়ি ও পরিবারের সদস্যরা তল্লাসীর মুখে পড়তে হয়েছে।
মঙ্গলবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষ কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশুর উপর ২৪টি সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ২৫ জন নারী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে একজনকে হত্যা, ১২ জন নারী ও শিশুকে ধর্ষণ, ৭ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা এবং ২ জন নারী ও শিশুকে অপহরণ ও পাচারের চেষ্টার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ২০২৩ সালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ১৩৫টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ৬৪৩ জন মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ৩১ জনকে গ্রেফতার ও সাময়িক আটক, ২৪৫ জনকে মারধর, আহত ও হয়রানি, মিথ্যা মামলার শিকার ৫৩ জন, ৬৪টি গ্রামে সামরিক অভিযান পরিচালনা, ৮৪টি বাড়ি ও পরিবারকে সেনা তল্লাসী, ৩১ পরিবারকে উচ্ছেদ ও উচ্ছেদের হুমকি, ৫টি নতুন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ ইত্যাদি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ২০২৩ সালে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কর্তৃক ৫৭টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ১ হাজার ৫৫ জন ও ৩০টি গ্রামের অধিবাসী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ১৯ জনকে হত্যা, ১৭ জনকে মারধর, ২১ জনকে অপহরণ, ২২ জনকে আটক, ৬ জনকে আটক করার পর পুলিশের কাছে সোপর্দ, ১৯৫ বম ও মারমা পরিবারের প্রায় এক হাজার গ্রামবাসীদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ এবং ২৫টি গ্রামের অধিবাসীদের নানা ধরনের হয়রানি ও উচ্ছেদের হুমকি প্রদান ইত্যাদি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া ২০২৩ সালে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যু কর্তৃক ২৪টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ১৯টি পরিবার ও ২১০ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ৬ জনকে হত্যা এবং ১৮টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ১৯৯৭ সালে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও উদ্বেগজনক হয়ে পড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়ন, ধর-পাকড়, জেল-জুলুম, হত্যা, গুম, মিথ্যা মামলায় জড়িতকরণ, ভূমি বেদখল, স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, সরকারি মদদে সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ, অনুপ্রবেশ, জুম্মদের সংখ্যালঘুকরণ, সাম্প্রদায়িক হামলা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, নারীর উপর সহিংসতা ইত্যাদি মানবতাবিরোধী ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও পার্বত্য চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামী লীগ সরকার গেল ২০০৯ সাল থেকে ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও বর্তমান সরকার পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তো গ্রহণ করেইনি অধিকন্তু চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে।
বিবৃতিতে দাবী করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটিকে পাশ কাটিয়ে তথা পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করে গেল ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পর্যালোচনা মূল্যায়ন ও পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি মূল্যায়ন, অগ্রগতি ও পরিবীক্ষণ সংক্রান্ত আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি’ গঠন করা এবং চুক্তি বিরোধী এই কমিটির মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে মর্মে অপপ্রচার চালানো। অথচ পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট ৪৭টি ধারা হয় সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত অবস্থায়, নয়তো আংশিক বাস্তবায়িত করে অথর্ব অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে আরো দাবী করা হয়, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে নিজেদের ব্যর্থতা ধামাচাপা দিতে নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির সকল স্তরের নেতাকর্মীসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত জুম্ম জনগণকে ‘সন্ত্রাসী’ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’, ‘চাঁদাবাজ’ ইত্যাদি তকমা দিয়ে অপরাধীকরণ করছে। তারই অংশ হিসেবে জনসংহতি সমিতিসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত অধিকারকর্মী ও জনগণকে সুপরিকল্পিতভাবে অবৈধ গ্রেফতার, বিচার-বহির্ভূত হত্যা, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে আটক, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণ, ওয়ারেন্ট ছাড়া ঘরবাড়ি তল্লাসী ও ঘরবাড়ির জিনিষপত্র তছনছ, মারধর, হয়রানি ইত্যাদি ফ্যাসীবাদী ও মানবাধিকার বিরোধী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
--প্রেস বিজ্ঞপ্তি।