ঈদের ছুটিতে পর্যটনের রাণী রাঙামাটি ঘুরে আসুন। রাঙামাটিতে পর্যটনের আকর্যনীয় স্পটের মধ্যে রয়েছে ঝুলন্ত ব্রীজ, সুভলং ঝর্ণা, কাপ্তাই লেক, ডিসি বাংলো, পুলিশের পলওয়েল পর্যটন, রাজবন বিহার,চাকমা রাজ বাড়ি, বালুখালী কৃষি খামার, বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দু রউফের সমাধি সৌধ,টুক টুক ইকোভিলেজসহ আদিবাসী শান্ত সবুজ গ্রাম ও তাদের জীবনযাত্রা।
এছাড়া বর্তমানে এ বর্ষা মৌসুমে রাঙামাটির প্রকৃতি নতুন রুপে সেজেসে। শুভলং ঝর্না তার পুরনো রুপ ফিরে পেয়েছে। তাই সবমিলিয়ে পর্যটকরা আত্বীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে নিয়ে এবার রাঙামাটির প্রকৃতির সৌন্দর্য্য অপন মনে উপভোগ করতে পারবেন।
বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দুরবর্তী পশ্চিমে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা, পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে, উত্তরে পার্বত্য খাগড়াছড়ি এবং দক্ষিণে পার্বত্য বান্দরবান জেলার অবস্থানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে শহর রাঙামাটি। রাঙামাটির মোট আয়তন হচ্ছে ৬ হাজার ৪শ ৮১ বর্গকিলোমিটার।
জলবিদ্যূৎ উৎপাদনের জন্য ১৯৬০ সালে কর্ণফূলী নদীর ওপর বাধঁ দিয়ে কাপ্তাইয়ে নির্মিত হয় ২৫৬ বর্গমাইল এলাকা বি¯তৃত কৃত্রিম জলধারা(কাপ্তাই হ্রদ)। এ জলধারে তলিয়ে গেছে ৫৪ হাজার একর প্রথম শ্রেনীর আবাদী জমিসহ পূরনো রাজবাড়ি, পূরণো বৌদ্ধ মন্দির, বাজার,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অসংখ্য ঘরবাড়ি। এ বাধেঁর ফলে উদ্ধাস্তু হয়েছিল প্রায় এক লাখের বেশী লোক। কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হওয়ার কারণে রাঙামাটিতে গড়ে উঠে আকর্ষনীয় পর্যটন স্পট। ৭০ দশকের শেষের দিকে সরকার রাঙামাটি জেলাকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষনা করে। একই সঙ্গে পর্যটকদের সুবিধার্থে আকর্ষনীয় স্পট নির্মাণ করে পর্যটন কর্পোরেশন।
দর্শনীয় স্থানগুলোতে কিভাবে যাবেন- চাকমা রাজ রাজবাড়ী, উপজাতীয় যাদুঘর, জেলা প্রশাসন বাংলো, রাজ বন বনবিহার ইচ্ছে করলে আপনি একটি সিএনজি বা বেবী টেক্সী ভাড়া করে ঘুরে আসতে পারেন। কারণ এগুলো একেবারেই শহরের মধ্যেই অবস্থিত। এখানে বলে রাখা ভাল, চাকমা রাজ বাড়ীতে অতীত চাকমা রাজ বংশের বেশ কিছু নিদর্শন রয়েছে। রাঙামাটির আরেকটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে রাজ বন বিহার। রাজ বন বিহার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি তীর্থস্থান হিসাবে পরিগনিত। বৌদ্ধ ধর্মের বেশ কিছু নিদর্শনও রয়েছে এখানে। উপজাতীয় যাদুঘরে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের কৃষ্টি,সংস্কৃতির প্রাচীন নিদর্শন। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনিষ্টিটিউটে এ যাদুঘর নির্মিত হয়েছে। রাঙামাটির আরেকটি প্রধান আকর্ষন হচ্ছে পর্যটন কমপে¬ক্সে। এ পর্যটন কমপ্লেক্সের ঝুলন্ত ব্রীজটি দেখার মতো। দুটি পাহাড়ের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে কাপ্তাই হ্রদের উপর ঝুলে আছে এ সেতু। রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু দেখতে হলে আপনাকে পর্যটন কর্পোরেশনকে মাথাপিছু ১০টাকা দিতে হবে।
এছাড়া সুভলং ঝর্ণা বা সুভলংএর প্রাকৃতিক দৃশ্যে,নানিয়ারচরের বুড়িঘাট এলাকায় বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ এর স্মৃতি সৌধ,পেদা টিং টিং, সাংফাং রেস্টুরেন্ট, ইকো টুক টুক ভিলেজএর পর্যটন স্পট দেখতে হলে আপনাকে অবশ্যই ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করতে হবে। এখানে মনে করিয়ে দেয়া ভাল সুভলং এর প্রাকৃতিক ঝর্ণা খুবই উপভোগ করার মতো ও সুভলং এর প্রাকৃতিকদৃশ্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। বর্তমান এ বর্ষা মৌসুমে রাঙামাটির প্রকৃতি নতুন রুপে সেজেসে। শুভলং ঝর্না তার পুরনো রুপ ফিরে পেয়েছে। তাই সবমিলিয়ে পর্যটকরা এবার রাঙামাটির প্রকৃতিক ঝর্না প্রাণ ভরে অপন মনে উপভোগ করতে পারবেন। নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে রয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়ক মুন্সি আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধ। বীর শ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়ক মুন্সি আব্দুর রউফ মুক্তিযুদ্ধের সময় নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে শহীদ হন। স্থানীয় এক আদিবাসী তাঁকে ওই স্থানে কবর দিয়েছিলেন। রাঙামাটির বিজিবি কর্তৃক ওই স্থানে এ স্মৃতিসৌধ নির্মান করা হয়েছে।
তবে এসব স্থান পরিদর্শনের সময় সারাদিনের জন্য নৌকা ভাড়া করলে এক সঙ্গে রাজবাড়ি, বন বিহার, পর্যটনের ঝুলন্ত সেতু ও জেলা প্রশাসকের বাংলোও দেখতে পারবেন। ইঞ্জিন বোটে করে যাওযার সময় কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জলরাশির বুক ছিড়ে যখন সুভলং এ দিকে এগোবেন তখন প্রথমে চোখে পড়বে বেসরকারী পর্যটন চাংপাং রেষ্টুরেণ্ট এবং এর কিছু দূরে এগুলে দেখতে পাবেন অপর একটি রেস্টুরেণ্ট। এসব রেষ্টুরেন্টে আদিবাসীদের ঐতিহ্যের খাবারসহ রকমারী খাবার খেতে পারেন।
চাংপাং রেষ্টুরেন্ট ফেলিয়ে সবুজ পাহাড়ের বুক ছিড়ে যখন সুভলং উদ্দেশ্যে এগোতে থাকবেন তখন দেখতে পাবেন কিছূ আদিবাসী গ্রাম। সেখানে রয়েছে নির্মল পাহাড়ি সরলতা ও জীবনযাত্রা। আপনি ইচ্ছে করলে সে সব গ্রাম ঘুরে দেখতে পারেন। এভাবে মনোমুগ্ধকর পরিবেশে যেতে যেতে এক সময় পৌঁছে যাবেন নয়নাভিরাম সুভলং। সুভলং এর ঝর্ণার কাছাকাছি পৌঁছতে দেখতে পাবেন দু’দিকে সুউচ্চ পাহাড়। এক সময় এখানে কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের জন্য পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল কিন্তু বাঁধ নির্মান করা হলে ভারতের কিছু এলাকা জলমগ্ন হয়ে যায়। তাই সে কারণে পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছিল। এর পর দেখতে পাবেন পাহাড়ের কোল থেকে নেমে আসা কয়েকটি ঝর্না। তবে এর মধ্যে সব চেয়ে বড় ঝর্ণাটিতে দেখলে সত্যিই মনের মধ্যে ভালো লাগবে। এসব ঝর্ণাতে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা ঝর্ণার পানির পাথুরে মাটিতে আছড়ে পড়ার অপূর্ব দৃশ্য।
এখানে আপনি ইচ্ছে করলে গোসল করতে পারবেন ও আপনার সাথে ক্যামরা থাকলে পছন্দ মত ছবিও নিতে পারেন। তবে এ ঝর্ণাটি দেখতে হলে আপনাকে প্রবেশ ফি হিসেবে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হবে। এরপর ঝর্ণা দেখা শেষ হলে আপনি কিছুক্ষনের জন্য সুভলং বাজারে ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে সেনাবাহিনীর একটি মনোরম ক্যান্টিনও রয়েছে। ইচ্ছে করলে সেখান থেকে হালকা নাস্তা, চা খেতে পারেন।
কারণ এখান থেকে সোজাসোজি আপনাকে রওনা দিতে হবে শহরে দিকে। এছাড়াও রাঙামাটি শহরের অদুরে বালুখালীতে হট্টিকালচার নার্সারীর বিশাল এলাকা জুড়ে যে উদ্যান রয়েছে তার সৌন্দয্যও পর্যটকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। হর্টিকালচার নার্সারীটি পরিণত হয়েছে আরেক পর্যটন কেন্দ্রে সারি সারি ফল ও ফুল গাছের সাথে রয়েছে কিছু বনের পশু পাখি কিচির মিচির ডাকের শব্দ। সব মিলিয়ে এ উদ্যান পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় স্থান হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।
বোট ভাড়া কোথায় পাওয়া যায়ঃ ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা বোট ভাড়া রাঙামাটি শহরে কয়েকটি স্থানে পাওয়া যাবে। তবলছড়ি বাজারস্থ বোট ঘাটে, রির্জাভ বাজার, বনরুপায়। এখানে বোট ওয়ালা নতুন লোক হলে আপনার কাছ থেকে হয়তো বেশী ভাড়া চাইতে পারে। তার জন্য দরদাম করে নেয়াই ভালো হবে। সারাদিনের জন্য ভাড়া বা শুভলং যেতে চাইলে আপনাকে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা দিতে হবে।
কেনাকাটা করতে চানঃ পাহাড়িদের তৈরী কাপড়-চোপড় ও হাতের তৈরী বিভিন্ন জিনিসপত্র আপনার বন্ধুর জন্য বা যে কারোর জন্য অথবা আপনার নিজের জন্য কেনাকাটা করতে পারেন। এসবে মধ্যে রয়েছে তবলছড়ি এলাকায়। বিশেষ করে তবলছড়ি বেইন টেক্স টাইল শো রুমে, বনরুপার জুমঘর ও রাজবাড়ি এলাকায় সজপদর। এসব শো রুম থেকে কম দামে বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনতে পারেন।
কোথায় উঠবেনঃ রাঙামাটি পর্যটন মোটেল। এই মোটেল শহর থেকে একটু দূরে হলেও মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে বেষ্টিত। এখানে প্রতি রুমের ভাড়া এসি বারশ টাকা, নন এসি ছয়শ টাকা। এছাড়া দল বেধে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বা পরিবার পরিজনদের নিয়ে থাকতে চান অসুবিধা নেই। এখানে কটেজের সুব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি কটেজের ভাড়া পড়বে দেড় হাজার টাকা। বেসরকারী পর্যটন পেদাটিং টিং এ যারা নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে রাতযাপন করতে পছন্দ বা যারা সদ্য বিবাহিত দম্পত্তি তারা এখানে হানিমুন করতে পারেন। এখানের প্রতিটি কটেজের ভাড়া পড়বে এক হাজার টাকা। এছাড়া হোটেল সুফিয়া, গ্রীণ ক্যাসেল, মোটেল জর্জসহ ইত্যাদি হোটেলে প্রতি রুমের এসি রুমে ভাড়া পড়বে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ও নন এসি ৬ থেকে এক হাজার টাকা। তবে কম দামের হোটলে থাকতে চান তাও পাবেন।
কোথায় খাওয়াদাওয়া করতে চানঃ পর্যটনের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট ও বার রয়েছে, তবলছড়ির অরণ্যেক রেস্টুরেন্ট, বনরুপায় ক্যাপে লিংক। এছাড়া দি রৌপ, রাজবাড়ির মেজাং ও হেবাং রেস্টুরেন্ট ,রির্জাভ বাজারের গ্রীন ক্যাসেল রেস্টুরেন্ট, বনরুপার কাটা পাহাড় এলাকায় আইরিশ হোটেলসহ কয়েকটি হোটেলে আদিবাসীদের তৈরী নিজস্ব খাবার খেতে ইচ্ছে করে পাবেন অবশ্যই। এসব রেষ্টুরেন্টে হুর হেবাং( বাশেঁর মধ্যে রান্না করা মুরগি তরকারী) বদা হেবাং(কলা পাতায় রান্নায় ডিম তরকারী) ইত্যাদি।
কাপ্তাই উপজেলাঃ কাপ্তাই না গেলে রাঙামাটি বেড়াতে আসা আরও একটি সাধ অপূর্ন থেকে যাবে। এখানে কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কর্ণফূলী পেপার মিলস্, কর্ণফূলীর নদীর অপূর্ব দৃশ্য, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যোন ইত্যাদি দেখার জায়গা রয়েছে। তবে কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কর্ণফূলী পেপার মিলস দেখতে চাইলে আপনাকে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি লাগবে। কাপ্তাই কর্ণফূলী নদীর ধারে খাওয়াদাওয়া করার জন্য অনেক রেস্টুরেন্টও রয়েছে। কাপ্তাইয়ে আপনি ইচ্ছে করলে রাতযাপনও করতে পারেন। তবে সে রকম ভালো মানের হোটেল নেই। তার চেয়ে কোন রেস্ট হাউসে উঠা ভালো হবে। কাপ্তাই যেতে হলে আপনি তবল ছড়ি বাজার থেকে স্পীড বোটে করে যেতে পারেন।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে বিমানে অথবা ট্রেনে করে চট্টগ্রাম এরপর রাঙামাটিযেতে পারেন। চট্টগ্রামে পৌঁেছ অক্সিজেন-এর বাস স্টান্ডে যেতে হবে। সেখান থেকে প্রতি ২৫মিনিট পর পর বিরতীহীন বাস ছাড়ে। ভাড়া পড়বে ১২০টাকা। তবে এখান থেকে আবার লোকাল বাসও পাওয়া যায়। আবার সরাসরি ঢাকা থেকে রাঙামাটি যেতে পারেন। ভাড়া পড়বে সাড়ে ৬শ টাকা। ঢাকার কমলাপুর স্টেশন, কলা বাগান, গাবতলী, টি টি পাড়া ফকিরাপুল কাউন্টার থেকে পাবেন ডলফিন,বিআরটিসি, শ্যামলীর টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন। এছাড়া সরাসরি শ্যামলী পরিবহনের এসি চেয়ার কোচ পাবেন কলা বাগান, মতিঝিল ও কল্যাণপুর থেকে বাসের টিকিট পাবেন। ভাড়া পড়বে ৯শ টাক। আপনার ঢাকা থেকে রাঙামাটি পৌঁছতে সময় লাগে ৭/৮ ঘন্টা আর চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটিতে আসতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.