সমতলের আদিবাসীদের উপর চলমান নির্যাতন ও ভূমি দখলের প্রতিবাদে এবং বাজেটে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবিতে রোববার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সংবাদ সন্মেলনে সারাদেশের আদিবাসীদের উপর সহিংসতা বন্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা,আদিবাসীদের উপর সহিংসতার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, সমতলের আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার্থে একটি স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠন করা, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দসহ চার দফা দাবী জানানো হয়েছে।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ও গবেষনা সম্পাদক মানিক সরেনের স্বাক্ষরিত এক প্রেস বার্তায় বলা হয়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির গোলটেবিল মিলনায়তনে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ও কাপেং ফাউন্ডেশন এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সন্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন। এসময় সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ; বর্ষীয়ান রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি; বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের বিষয়টি অর্থমন্ত্রী যদি সামান্য টাকা বলেন তাহলে আদিবাসীদের জন্য গত বছরে বরাদ্দকৃত ২০ কোটি টাকাতো সামান্যের চাইতেও সামান্য টাকা। তিনি অর্থমন্ত্রীর কাছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য আদিবাসীদের জন্য সামান্য ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার দাবী জানান। রাজনৈতিক দলগুলো বিপন্ন আদিবাসীদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না এমন অভিযোগ করে তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার পেছনে যদি রাজনৈতিক দলগুলো দাঁড়াতো তাহলে স্থানীয় প্রশাসন আদিবাসীদের বিষয়ে আন্তরিক হতো এবং আদিবাসীদের উপর নির্যাতন কিছুটা হলেও কমে যেত।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য বলেন, আদিবাসীদের প্রতি অন্যায় অত্যাচার কারা করছে তা কিন্তু আমরা জানি। এমনকি প্রভাবশালী দলের নেতারাও কিন্তু অনেক সময় ভূমিদস্যুদের ও নির্যাতনকারীদের সহায়তা করছে। গোপনে মধুপুরে আদিাবসীদের জায়গায় সরকার যে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করেছে সেটা অন্যায়। এর আগেও সেখানে রক্তপাত হয়েছে। এটি নিয়ে নিশ্চয় সরকারের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। তারপরেও আবারো সরকার এ কাজ কিভাবে করছে সেটি আমার বোধগম্য নয়।
আদিবাসীদের জন্য বাজেট বরাদ্দ বিষয়ে তিনি বলেন, বাজেটে সকলের সমান অধিকার একটি ন্যায্য অধিকার। এটা কোন দান দক্ষিনার বিষয় নয়। তাই আদিবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজেট বরাদ্দ অত্যাবশ্যক।
ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন, নাইক্ষ্যংছড়িতে যে বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যাকান্ড ঘটনা ঘটলো তার পরেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন নিজেদের লোকজনরাই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংখ্যালঘু হিসেবে নয় নাস্তিক হিসেবে নাকি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে শাস্তি দিয়েছেন বলে সেখানকার সাংসদ বলছেন। আসলে এভাবেই এদেশের সংখ্যালঘু ও আদিবাসী মানুষদের প্রতি অত্যাচার নির্যাতন চলছে, শিক্ষকদের প্রতি অত্যাচার চলছে। প্রভাবশালী ব্যক্তি এমনকি কিছু কিছু সাংসদরাও এতে যোগ দিয়েছেন। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেওয়ার অনুরোধসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি এই আগামী অর্থবছরে সমতলের আদিবাসীদের জন্য ১শ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দের দাবি জানান।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, সম্প্রতি জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে বাংলাদেশের এক প্রতিনিধি তাদের অনুরোধ করেছেন যেন আমরা আদিাবসীদের ব্যাপারগুলো একটু নরম করে বলি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আদিবাসীদের প্রতি সরকার দৃষ্টিহীন। বরং ক্ষমতাবান প্রভাবশালী মানুষের জন্য সরকারের দৃষ্টি আছে। তিনি বলেন, প্রতি বছর আদিবাসীদের বাজেটের জন্য অর্থমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করা হলেও কোন কাজ হয় না। প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করা হয় না।
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সমতলসহ পাহাড়ের আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, উচ্ছেদ, মারপিট, হত্যাসহ আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ এর মতো ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটে যাচ্ছে। এ কারণে আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত শঙ্কার মধ্যে দিনাতিপাত করছে এবং অনেকেই ভয়ে এ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। ইতোমধ্যে গত কয়েক বছরে আদিবাসীরা অনেকেই দেশত্যাগ করেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ২০১৪ নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের উপর ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসানের’ (২২.১ ধারা) অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে সেটি হচ্ছে না।
উত্তরবঙ্গসহ সমতলের আদিবাসীদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন, মারপিট, উচ্ছেদসহ সকল ধরনের সহিংসতার পেছনে ভূমি দখলই প্রধান কারণ বলে তিনি মন্তব্য করে বলেন, এখন পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে তার সবটাই মূলত ভূমি কেন্দ্রিক। সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ভূমি কমিশন গঠনের জন্য সরকার ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে যথাক্রমে অনুষ্ঠিত ৯ম ও ১০ম জাতীয় সংসদে নির্বাচনে অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু সরকার পূর্ববর্তী মেয়াদে এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ তো গ্রহণই করেনি, এমনকি বর্তমান মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকার এ বিষয়ে এখনো নিশ্চুপ রয়েছে। যার কারণে ভূমি কেন্দ্রিক সমস্যাগুলো দিন দিন আরো জটিল হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আগামী বাজেটে অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে যেন আদিবাসীদের জন্য ন্যায় সঙ্গত ও পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ করা হয় এবং বাজেট বক্তৃতায় আদিবাসীদের জন্য আলাদা একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করার জন্য তিনি জানান।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.