২০০৭ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মোট ৪৩৪ জন আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শুধুমাত্র ২০১৫ সালে ৬৯ টি ঘটনার মধ্যে ৩৮টি পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং বাকিগুলো সমতলে সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ টি ধর্ষণ, ১২ টি গণধর্ষণ, ১১ টি শারীরিক লাঞ্ছনা, ৬ টি শারীরিক ও যৌন হয়রানি এবং ১৬ টি ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। এসব ঘটনায কোন একটিরও দৃষ্টান্ত নেই যেখানে ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হয়েছে।
মঙ্গলবার ঢাকায় ‘বাংলাদেশের আদিবাসী নারীদের সামগ্রিক পরিস্থিতি রিপোর্ট ২০১৫-এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
কাপেং ফাউন্ডেশনের ফাল্গুনী ত্রিপুরার পাঠানো প্রেস বার্তায় বলা হয়, ডেইলি স্টার ভবনের তৌফিক আজিজ খান কনফারেন্স হলে কাপেং উন্ডেশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের উদ্যোগে ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহায়তায় মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভায় অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেস্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।
কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সাবেক তথ্যকমিশনার অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ওবায়দুল হক, আচিক মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের যুগ্ম আহ্বয়ক চৈতালী ত্রিপুরাসহ প্রমুখ। মূল রিপোর্টউপস্থাপন করবেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পার্বতী রায়। সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, আদিবাসী নারীদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনাকে অবমাননা করারই শামিল। সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরুর মধ্যে বিভাজন আজ জাতীয় রাজনীতিরমধ্যে ঢুকে গেছে।
তিনি আরো বলেন, আদিবাসী নারী নির্যাতনের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি আদিবাসী নারীদের আরো ঝুকিপূর্ণ করেছে। বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে গণতন্ত্রের মোড়কে সামরিকতন্ত্র পরিচালনা করাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবমাননারই শামিল। দেশের নারী-পুরুষের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে প্রত্যেকের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠারাষ্ট্রের নিশ্চিত করতে হবে। আদিবাসী নারীর সহিংসতা রোধে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও সমতলে ভূমি কমিশন গঠনে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
সাবেক তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, আদিবাসী নারীদের উপর নির্যাতন আদিবাসীদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদের একটি চরম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সমতল এবং পাহাড়ে আদিবাসী সমাজেও নারীদের রক্ষার জন্যে কোন পৃথক আইন নেই।
শাহীন আনাম বলেন, নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সবদিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তারপরেও নারীদের প্রতি সমাজের একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। পার্বত্যঞ্চলে নারী নির্যাতনকে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সংবিধানে বৈষম্যহীন দেশের কথা বলা থাকলেও আদিবাসীদের জন্যেসেটা আজ স্বপ্ন। অনেক ঘটনায় আদিবাসী নারীরা সুষ্ঠ বিচার না পাওয়ার কারনে তারা আরো প্রান্তিকতায় উপনীত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারে নীতি-নির্ধারক মহলের ভেবে দেখা উচিত।
অধ্যাপক ড. ওবায়দুল হক বলেন, আদিবাসী নারীরা আদিবাসী হবার কারনে আরো বেশি নির্যাতিত হয়। সামগ্রিকভাবে নির্যাতনের সংখ্যা খুব কম হলেও জনসংখ্যার অনুপাতে এই হার যথেষ্ট বেশী। মিডিয়ার উচিত ধষর্নের মত নির্যাতনের ঘটনাগুলোর ফলো-আপ রির্পোট প্রদান করা যাতে করে জনগনকে সচেতায়ন করা সম্ভব হয়।
সুলেখা ম্রং বলেন, গারো সমাজ মাতৃতান্ত্রিক হলেও সম্পত্তি বাটোয়ারা-বন্টন, সমাজ পরিচালনা সম্পূর্ন কাজ করে থাকেন পুরুষেরা, নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহনের মত প্রকৃয়ায় এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
চৈতালী ত্রিপুরা বলেন, দেশের নারী নির্যাতনের চিত্র এবং আদিবাসী নারীদের নির্যাতিত হবার চিত্র এক নয়। আদিবাসী নারীরা প্রতিনিয়ত পাহাড়ে নির্যাতনের শিকার হলেও রাষ্ট্রযন্ত্র নিরব থাকে। আদিবাসী নারীদেরকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে, পার্বত্য ভূমি কমিশন কার্যকরএবং তৎসঙ্গে সমতল আদিবাসীদের জন্যে পৃথক ও স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।
পল্লব চাকমা বলেন, আদিবাসীদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলছে। এই সহিংসতা কমানোর প্রচেষ্ঠা হিসেবেই প্রতি বছর কাপেং এই বার্ষিক রির্পোট জনগণের কাছে পেশ করে থাকেন। মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলোতে আদিবাসী-বাঙ্গালী সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
পার্বতী রায় তার মূল রিপোর্ট-এ উপস্থাপনে বলেন, আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৭ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মোট ৪৩৪ জন আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং সেসব ঘটনায কোন একটি দৃষ্টান্ত নেই যেখানে ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হয়েছে। ২০১৫ সালে ৬৯ টি ঘটনার মধ্যে ৩৮টি পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং বাকিগুলো সমতলে সংগঠিত হয়েছে। এসব ঘটনার বেশির ভাগ ভিকটিম পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ছিল।
আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক বিষয়ের মধ্যে ধর্ষণ অন্যতম। ২০১৫ সালে ১৪ টি ধর্ষণ, ১২ টি গণধর্ষণ, ১১ টি শারীরিকলাঞ্ছনা, ৬ টি শারীরিক ও যৌন হয়রানি, ১৬ টি ধর্ষণের চেষ্টা সহ ৬৯ টি ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভূমি বিরোধ ও সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের কারণে সংখ্যালঘু আদিবাসী নারীরা সহিংসতার শিকার হয় এবং অধিকাংশ ঘটনাই অ-আদিবাসী দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে।
তিনি আরো বলেন, আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সহিংসতার আইনি সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সহযোগিতা এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ২০১৪ সালের তুলনায় আদিবাসী নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা কমলেও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের জীবনে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন আসেনি। এছাড়া পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব আদিবাসী নারীর চলাফেরা এবং গতিশীলতার উপর নিয়ন্ত্রণ ও তাদের কন্ঠরোধ করার নিমিত্তে শারীরিক ও যৌন সহিংসতাকে মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিভিন্ন ধারা অবাস্তবায়িত থাকার কারণেও আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা দিনদিন বেড়ে চলেছে। তন্মধ্যে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার না করা, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন না হওয়া, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিষদগুলোকে ক্ষমতায়িত না করা, পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থায়ী বাসিন্দাদের নামে বরাদ্দকৃত জমির লীজ বাতিল না করা ইত্যাদি কারণে আদিবাসী নারী ও শিশুর প্রতিদিনদিন সহিংসতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি তার রিপোর্টে বলেন, প্রান্তিক ও সুবিধা বঞ্চিত নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকার বেশ কিছু উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু অধিকাংশ সরকারি মূলনীতিসমূহ ও উন্নয়ন পদক্ষেপগুলোতে আদিবাসী নারীদের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পায় না।
তবে সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগ যেমন নারী ও কন্যাশিশুদের বিরুদ্ধেসহিংসতা রুখতে ইউপিআর দ্বিতীয় চক্রের সুপারিশমালা, ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৫-১৬, ২০১৯-২০) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আদিবাসী নারী উন্নয়নের বিধান রাখা হয়েছে। যা হোক, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ আদিবাসী নারী ও অন্যান্য উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং কৌশলে আদিবাসী নারীদেরকে তেমনভাবে মূল্যায়নকরা হয়নি। জাতীয় পর্যায়ে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবেলার অনেক পরিকল্পনা, কৌশল ও আইন থাকলেও তা আদিবাসী নারীবান্ধব নয়। ফলস্বরূপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়মুক্তি প্রতীয়মান হয় এবং সুবিচার নিশ্চিত হয় না।
এমনকি আদিবাসী নারীরা স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত ও উপেক্ষিত। দেশে শিক্ষানীতি, প্রাথমিক শিক্ষায় জেন্ডার ব্যবধান দূরীকরণে জাতীয় অর্জন এবং নারী শিক্ষা প্রসারে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও আদিবাসী শিশু, বিশেষত কন্যা শিশুরা শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। উপরন্তু, প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারীআদিবাসী শিশুরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতা আদিবাসী নারীদের শিক্ষাগত ক্ষমতায়নে প্রধান অন্তরায়। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে বাল্যবিবাহের হার খুব বেশী। আদিবাসী নারীরা মা ও শিশুস্বাস্থ্য সেবার পর্যাপ্ত সুবিধা না পাওয়ার কারণে আদিবাসী মায়েদেরস্বাস্থ্যের অবস্থা সন্তোষজনক নয়।
এসময় তিনি ৭ দফা সুপারিশ উপস্থাপণ করেন। এর মধ্যে রয়েছে, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আদিবাসী পাহাড়ী জাতিগোষ্ঠীর জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতিসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, করা। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা এবং এলক্ষ্যে বাস্তায়নের সময়সূচি ভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা,শাসনতান্ত্রিক কর্মকান্ডে আদিবাসী পাহাড়ী নারীদের প্রতিনিধিত্ব ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরণের জন্য জাতীয়সংসদসহ স্থানীয় পরিষদে আদিবাসী নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ, আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান , জাতীয় ও স্থানীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, আদিবাসী নারীদের বিশেষ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও সম্পত্তিতে আদিবাসী পাহাড়ী নারীর উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও আদিবাসী শিশুদের জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা এবং সহিংস ঘটনার শিকার আদিবাসী পাহাড়ী নারীর জন্য আইনী সহায়তা প্রদান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.