বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম মৌলিক সমস্যা হচ্ছে ভূমি সমস্যা। এ সমস্যা এখনো সমাধান হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আরেকটি অন্যতম বিষয় ছিল সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা। সেই কাজটাও তেমন অগ্রগতি সাধিত হয়নি। এসব কারণে আদিবাসীদের মধ্যে এ ধরনের অনাস্থা ও অবিশ্বাস তৈরী হয়েছে।
আদিবাসী এলাকায় পর্যটন করতে হলে আদিবাসীদের সংস্কৃতি, তাদের জীবনযাপন ইত্যাদি বিষয়সমূহের প্রতি খেয়াল রেখেই পর্যটন বিস্তারের কাজ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন শিল্প বিকাশে পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের সাথে আঞ্চলিক পরিষদ ও আদিবাসীদের একটা বিরোধ রয়েছে। এখানে সরকারের সাথে আঞ্চলিক পরিষদের একধরনের বিচ্ছিন্নতা কাজ করেছে। এ বিরোধ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া দরকার।
বৃহস্পতিবার রাজধানীতে “আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে পর্যটন ও উন্নয়ন: আদিবাসীদের অংশীদারিত্ব ও সরকারের ভূমিকা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
কাপেং ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র মানিক সরেন-এর স্বাক্ষরিত এ প্রেস বার্তায় জানান, বৃহস্পতিবার দিন ব্যাপী সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত কাপেং ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও একশনএইড এর যৌথ উদ্যোগে গোলটেবিল আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন কাপেং ফাউন্ডেশন ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন। আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন সাবেক তথ্য কমিশনার এবং জাতীয় ইউপিআর ফোরামের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. সাদেকা হালিম, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশন উপদেষ্টা মঙ্গল কুমার চাকমা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর। মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন চঞ্চনা চাকমা, রসুল ইসলাম, খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, সুস্মিতা চাকমা, হানা শামস আহমেদ প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাশেদ খান মেনন এমপি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারার সংশোধনীর জন্য অনেক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু দু:খজনক হল সেই আইন এখনো সংশোধিত হয়নি।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন বিকাশের বিষয়ে অবশ্যই যেখানে পর্যটন হবে সেই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততার ব্যাপারটি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এটা সত্য যে বান্দরবানের নীলগিরিতে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনকালে সেখানকার ম্রোদের উচ্ছেদ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ পর্যটন শিল্প এর বিশাল সম্ভাবনা আছে। আদিবাসী-বাঙ্গালি সকলে মিলে বাংলাদেশের পর্যটনকে বিকাশ করতে হবে। ইকো ট্যুরিজম, কমিউনিটি বেসড ট্যুরিজম গড়ে তুলতে হবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বীও হয়ে উঠবে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করা যাবে।
আলোচকের বক্তব্যে সাদেকা হালিম বলেন, পার্বত্য এলাকার জমিগুলোকে আমরা কিভাবে দেখি? যেখানে পর্যটন হয়েছে সেখানকার জায়গাগুলো কাদের ছিল? নীলগিরির জায়গাগুলো ম্রোর আদিবাসীদের ছিল। কিন্তু ম্রোরা যখন প্রতিবাদ করেছিলেন তখন তাদের ভয় ভীতি ও নির্যাতন করা হয়েছিল। এভাবেই পার্বত্য এলাকায় পর্যটন তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ি পর্যটন বিষয়টি কি যথাযথভাবে হস্তান্তর হয়েছে? আমি বলবো হয়নি। তবে যেভাবেই যেখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠুক সেখানে আদিবাসী কর্তৃত্ব বজায় রাখার দাবি জানাচ্ছি।
আলোচক বক্তব্যে সাধুরাম ত্রিপুরা বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের অধীনে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর ফলে আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রনয়ন হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ি হস্তান্তরযোগ্য বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সাথে পর্যটন বিষয়ও জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই পর্যটন বিষয়ে যথাযথভাবে হস্তান্তর করা হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদ সকলকে নিয়ে সমন্বয় করে যেভাবে কাজ করতে চায় সরকার যেন তা চায় না। পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটন বিকাশের ক্ষেত্রে অবশ্যই আদিবাসীদের মতামতকে গুরুত্বসহকারে দেখাসহ দ্রুত পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের তিনি দাবি জানান।
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, সম্প্রতি পটুয়াখালি বরগুনায় ঘুরে এসে দেখি সেখানকার রাখাইন আদিবাসীদের পর্যটনের নামে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাদের জনসংখ্যাকে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। প্রকৃতিকে নষ্ট করে পর্যটন গড়ে তোলার যে নব্য চিন্তাভাবনা এবং যাদের জন্য উন্নয়ন তাদের কথা না ভেবে যে পর্যটন তড়ে তোলার প্রয়াস তা সত্যিকারের পর্যটন হবেনা। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক-বেসামরিক আমলাদের অনেকেরই তাদের নিজেদের নামে পাহাড় রয়েছে। সেইটা কি ঠিক হচ্ছে। আদিবাসীদের স্থানীয় সংস্কৃতি ঐতিহ্য ধ্বংস করে স্থানীয় আদিবাসীদের দেওয়া নামগুলো মুছে ফেলার রাজণীতি ভলো হবে না।
স্বাগত বক্তব্যে সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসী অঞ্চলে পর্যটন করার ক্ষেত্রে যেন আমরা সেখানকার সকল মানুষকে যুক্ত করতে পারি। এমন যেন না হয় সেখানে মানুষ যাবে, দুই দিন থাকবে খাবে আর চলে আসবে। পর্যটন এমন হবে যেন তা আদিবাসীদের সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রথাগত ব্যবস্থা সবকিছুকে পর্যটকরা ইতিবাচকভাবে নেয়।
সভাপতির বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে কোন কিছু করার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদকে জানানো বা তাদের সম্মতি নেওয়ার চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সরকার তার এই প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে মানছে না। ফলে সেখানে পর্যটন বিকাশেও আদিবাসীদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরে আগে অনেক শালবন ছিল, সেখানে আদিবাসীরাও ছিল। কিন্তু এখন আর আদিবাসীরা নেই। আদিবাসীদের ভূমি রক্ষা না হলে পর্যটন বিকাশেও আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব তৈরি হবে না। পর্যটন বিকাশে আদিবাসী-বাঙালি সবাই যেন একসাথে কাজ করতে পারে আশা করি সরকার সেই পরিবেশ তৈরি করবে।
মুল প্রকন্ধে মঙ্গল কুমার চাকমা বলেন, জাতীয় পর্যটন নীতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন অনুসারে ‘পর্যটন (স্থানীয়)’ বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয় হলেও এবং অঞ্চল পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব থাকলেও এ অঞ্চলের পর্যটন-আকর্ষণসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যটন উন্নয়ন সমন্বয় সাধনের জন্য পর্যটন নীতিতে এসব প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান/পরিষদসমূহের কোন ভূমিকা রাখা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনি অধিকার সংরক্ষণের অঙ্গীকার করলেও আদিবাসী বিষয়ে সরকার সম্পূর্ণভাবে ইউ-টার্ন দেয় বা উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছে। আদিবাসী এলাকায় পর্যটন করার ক্ষেত্রে আদিবাসী জনগণের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ও তাদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের স্বার্থে পর্যটন করতে হবে এবং আদিবাসীসহ স্থানীয় জনগণের অধিকার, জীব-বৈচিত্র্য ও পরিবেশ বান্ধব ‘ইকো-ট্যুরিজম’ নিশ্চিত করতে হবে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.