পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারীদের আত্ননিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী সাবেক সাংসদ প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার(এমএন লারমা) নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে সশস্ত্র সংঘাত অবসান ঘটিয়ে সংগঠনটির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার(সন্তু লারমা) নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়। এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর আন্দোলনের অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে শনিবার ৫৩ বছরে পদার্পন করেছে। এ উপলক্ষে শনিবার রাঙামাটিতে আয়োজন করা হয় গণ সমাবেশ ও আলোচনা সভা।
শহরের কুমার সুমিত রায় জিমনোসিয়াম মাঠে গণ সমাবেশ ও আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ উষাতন তালুকদার। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সদস্য গুনেন্দু বিকাশ চাকমার সভাপতিত্বে উদ্বোধক ছিলেন জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্য কেএসমং মারমা, আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি ভবতোষ দেওয়ান, হিল উইমেন্স ফেডারেশন সভাপতি শান্তিদেবী তংচংগ্যা। স্বাগত বক্তব্য জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক জুয়েল চাকমা। সমাবেশ শুরুর আগে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং ফেলুন উড়িয়ে সমাবেশের উদ্বোধন করেন অতিথিরা। সমাবেশে বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিলসহকারে অংশ নেন পাহাড়ী লোকজন। সমাবেশে গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা গণ সংগীত পরিবেশন করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্য উষাতন তালুকদার পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার যে অপ্রচার হচ্ছে সেই অপপ্রচার থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন,দেশের স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বের কথা মেনে নিয়ে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন নয় অন্তর্ভুক্ত হবে। তাই কালক্ষেপন না করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা উচিত।
তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্মল্যান্ড নাম দিয়ে জাতীয় পতাকা,জাতীয় সংগীত ও মুদ্রার নাম দেওয়া হয়েছে সেটা ঠিক নয়। আজবোজে কিছু লোক বিভ্রান্ত করার জন্য এ অপপ্রচার করা হয়েছে। পিসিজেএসএস এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট ্নয়। তাই এসব ভুল ধারনা থেকে সরকার ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। আজবোজে নানাভাবে রঙ ছড়িয়ে মিথ্যাভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানো সেটা শুভ হবে না।
ঊষাতন তালুকদার বলেন, একটি রাজনৈতিক পার্টি হলো সম্মিলিত জনগণের ইচ্ছাশক্তির ফসল। পার্টি হলো উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জন্ম হয়েছে জনগণের প্রত্যাশা, আকাক্সক্ষার প্রেক্ষিতে জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে। এই পার্টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও নীতি-আদর্শ নিয়ে আজও পর্যন্ত তার রণনীতি ও রণকৌশল সাজিয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ রয়েছে। জনসংহতি সমিতি হারিয়ে যায়নি। জনসংহতি সমিতি এখনো আন্দোলনরত। আন্দোলনের রূপ পাল্টেছে, ভবিষ্যতেও পাল্টাবে। কাজেই জুম্ম জনগণকে ভয় পেলে চলবে না। সত্য-মিথ্যা যাচাই করে আন্দোলনকে বুকে ধারণ করতে হবে। যেকোনো সময় যে-কোনো প্রকার সংগ্রামের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে।
সাধুরাম ত্রিপুরা বলেন, ব্রিটিশ আমলে জুম্মদের পৃথক শাসনব্যবস্থার জন্যে ১৯০০ সালের রেগুলেশন নামে একটি আইন প্রবর্তিত হয়। কিন্তু পাকিস্তান আমলে পাকিস্তান সরকার এ আইনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা বাতিল করে। ফলে প্রথাগত শাসনকাঠামো বিনষ্ট হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশকারীদের বৈধতা দেওয়া হয়। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে এদেশের জুম্ম জনগণকে দেশছাড়া করা হয়। এতে জুম্মদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে যায়। আর স্বাধীন বাংলাদেশে ৭২ এর সংবিধান প্রণয়নকালে জুম্ম জনগণের জাতীয় পরিচয় মুছে দেওয়া হয় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে জুম্ম জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় এদেশের জুম্ম জনগণকে একত্রিত করার জন্য এম এন লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। সেসময় থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সুদক্ষ নেতৃত্বে জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই চলমান রয়েছে। সংগ্রামের ফসল হিসেবে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পেয়েছি। এ চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের ঐতিহাসিক দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মকে কাঁধে নিতে হবে।
কে এস মং মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়ে আসছে। পার্বত্য অঞ্চলের জুম্ম জনগণ সামন্ততান্ত্রিক সমাজের নিষ্পেষণ, বিজাতীয় শাসন-শোষণ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভাবনায় নিমজ্জিত ছিল। শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা, অত্যাচারের নাগপাশ ছিন্ন করতে জন্ম লাভ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। এম এন লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন শুরু করে। সে সময় এন এন লারমা চার দফাবিশিষ্ট একটি দাবিনামা শেখ মুজিবের কাছে জমা দেন। কিন্তু শেখ মুজিব সেই দাবিনামা প্রত্যাখ্যান করেন।
তিনি আরো বলেন, ১৯৭৫ সালের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হলে সশস্ত্র সংগাম শুরু করে। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এ চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কোনো সরকার সদিচ্ছা দেখায়নি। আর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈষম্য বিরোধের কথা বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন খুবই কমই দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্র কাঠামোর যদি সংস্কার করতে হয় তাহলে সকল নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুয়ের প্রতিনিধি থাকতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টপ্রাম চুক্তিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের লড়াই সংগ্রামে ছাত্র ও যুব সমাজকে জেলকে ভয় পেলে চলবে না, মরণকে ভয় পেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে আমরা এমনিতেই মরে গেছি। তাই ছাত্র ও যুব সমাজ তথা সকল জুম্ম জনগণকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে এসে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে হবে।
ভবতোষ দেওয়ান বলেন, মহান পার্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৫৩ বছরের লড়াইয়ের ইতিহাসে আমরা অনেক লড়াকু বীরযোদ্ধাকে হারিয়েছি। আমরা হারিয়েছি মহান নেতা এম এন লারমাকে, অগ্নিকন্যা কল্পনা চাকমাকে। শহীদের তালিকা আরো দীর্ঘ। কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। রক্তস্নাত পথে জনসংহতি সমিতি শাসকগোষ্ঠী নামক দানবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণ দীর্ঘ সময় লড়াই করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পেয়েছে। চুক্তির আওতায় জুম্ম জনগণ পার্বত্য মন্ত্রণালয় পেয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পেয়েছে। যদি চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন হতো তাহলে জুম্ম জনগণ বিশেষ শাসনকাঠামো পেতো। তাই মহান পার্টির নেত্বৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সামিল হতে হবে।
শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্বত্য অঞ্চলের জনসাধারণ মনে করেছিল এবার তারা বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক একটি স্বাধীন দেশে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই প্রয়োজন হয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই-সংগ্রামের। পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিভাবক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সুদক্ষ নেতৃত্বে এখনও পর্যন্ত এ লড়াই জারি রয়েছে। এ লড়াইয়ে ছাত্র ও যুব সমাজ তথা এ দেশের জুম্ম জনগণকে শামিল হতে হবে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন, অবৈধভাবে ভূমি বেদখল, ধর্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রম এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
--হিলবিডি/সম্পাদনা/সিআর.