পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের কার্যক্রম স্থগিতের দাবিতে দশ হাজার স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে পেশ করা হয়েছে। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাখা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে এই স্বারকলিপি প্রদান করা হয়েছে।
সোমবার বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের নেতা বিনোতা ময় ধামাই-এর স্বাক্ষর করা এক প্রেস বার্তায় বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে স্বারকলিপি প্রদানকালে এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি সভাপতি গৌতম দেওয়ান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা,পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির নেতা শৈলজ বিকাশ চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা,বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সম্পাদক বিনোতা ময় ধামাই, সংগঠনের অর্থ সম্পাদক এন্ড্রু সলোমার ও বাবলু চাকমা।
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, উচ্চ শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি বা জনগোষ্ঠীর উন্নতি হতে পারে না এবং উচ্চ শিক্ষা তথা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-নির্ভর আধুনিক জ্ঞানচর্চার কোন বিকল্প নেই। তাই স্বভাবতই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরাও বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজের বিপক্ষে নয়। কিন্তু অত্যন্ত দু:খজনক যে, এই বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ পার্বত্যবাসীর মতামত নেয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা, ছাত্রছাত্রী ভর্তি ইত্যাদির ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান স্বাতন্ত্র বিশেষ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেয়া হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত রেখে যান্ত্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এখনো পুর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। অনির্বাচিত অর্ন্তবর্তী পরিষদ দিয়ে বছরের পর বছর ধরে এসব পরিষদগুলো অগণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ এখনো নিষ্পত্তি হয়নি এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর নিয়মিত সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়ে চলেছে। ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের এখনো তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন করা হয়নি।
অস্থানীয়দের নিকট দেয়া ভূমি লীজ এখনো বাতিল করা হয়নি এবং লীজ বাতিল না হওয়ায় পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীরা নানা হয়রানি ও উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কাজ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে অগ্রগতি লাভ করেনি। এমনিতর এক জটিল ও নাজুক পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হলে আরেকটি নতুন রাজনৈতিক-সামাজিক-জনমিতি সংকট তৈরি হবে বলে স্বারকলিপিতে বলা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রসারের নামে জনমতের বিপরীতে তথা পার্বত্যবাসীর আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাতন্ত্র্য বিশেষ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নিয়ে দেশে বিদ্যমান অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজের ন্যায় আইন ও নীতিমালা অনুসারে স্থাপিত ও পরিচালিত হলে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজ পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রসারের পরিবর্তে নতুন সংকট তৈরি করবে।
স্বারকলিপিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম স্থগিত রাখা এবং এ সমস্যা সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করা।
বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাতন্ত্র বিশেষ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেয়া এবং রিজেন্ট বোর্ডসহ পরিচালনা সংস্থাগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও প্রথাগত প্রতিষ্ঠানসহ পাহাড়িদের দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধি রাখা, এবং ভাইস চ্যাঞ্জেলর ও রেজিষ্টারসহ বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষক নিয়োগ এবং ছাত্রছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে কমপক্ষে শকরা ৮৫ শতাংশ আসন পাহাড়িদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার দাবি জানানো হয় স্বারকলিপিতে।
এছাড়া স্বারকলিপিতে প্রস্তাবিত রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের পূর্বেপার্বত্যাঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অধিকসংখ্যক বিষয়ে অনার্স ও মাষ্টার্স কোর্স চালুসহ পার্বত্যাঞ্চলের শিক্ষা খাত উন্নয়নের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করা; দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজগুলোতে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের অধিকতর কোটা সংরক্ষণ করা এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণাসহ উচ্চ শিক্ষার জন্য অধিক সংখ্যক বৃত্তি প্রদান করা; তিন পার্বত্য জেলার সদরে প্যারা-মেডিকেল ইনস্টিটিউট ও পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করা এবং তিন পার্বত্য জেলার সরকারী ও বেসরকারী প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মহাবিদ্যালয়ে স্তরে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষকদের আবাসন ও ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেলের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার জন্য দাবি জানানো হয়েছে।
–হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.