পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ দ্রুত ও পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবীতে বৃহস্পতিবার রাঙামাটিতে প্রতীক অনশন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
প্রতীকী অনশন কর্মসূচি সমাবেশে আদিবাসী নেতৃবৃন্দ বলেন,পার্বত্য চুক্তির ১৭ বছরেও সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বিক পরিস্থিতির কোন অগ্রগতি হয়নি। সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন নামে পার্বত্য গণমানুষের সাথে প্রতারণা করছে এবং চুক্তি বিরোধী কার্যকলাপ ও বিভিন্ন আইন চাপিয়ে দিচ্ছে। নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার টেকসই সমাধানে, এ অঞ্চলের স্থায়ীত্বশীল শান্তি প্রতিষ্ঠায়, সর্বোপরি এখানকার স্থায়ী অধিবাসীদের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। তাই আর তালবাহানা ও অজুহাত নয়। দেশের স্বার্থে এবং পার্বত্যবাসীর শান্তি ও সম্প্রীতির লক্ষে পার্বত্য চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসতে হবে। নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চুক্তি পুর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্ষন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার ব্যক্ত করেন।
রাজবাড়ীস্থ পেট্রোল পাম্প চত্বর ও শিল্পকলা একাডেমী চত্বর এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি ও আদিবাসী ফোরাম পার্বত্যাঞ্চল শাখার উদ্যোগে প্রতীক অনশন কর্মসূচি চলাকালে সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান। অন্যান্যর মধ্যে বক্তব্যে রাখেন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মানিক লাল দেওয়ান, আদিবাসী ফোরাম পার্বত্যাঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, শিক্ষাবিদ প্রফেসর মংসানু চৌধুরী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নিরূপা দেওয়ান, খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যাপক মধু মঙ্গল চাকমা, এমএন লারমা মোমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, নারী নেত্রী ডনাই প্রু নেলী, নারী নেত্রী এ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেকস সদস্য বিনোদ বিহারী চাকমা, রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদ এর চেয়ারম্যান অরুন কান্তি চাকমা বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যবা মং মারমা,প্রবীন সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে প্রমুখ।
সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্ষন্ত এ প্রতীক অনশন কর্মসূচি চলে। এ কর্মসূচিতে তিন পার্বত্য জেলার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান-কার্বারী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী, ব্যবসায়ী ও উন্নয়ন কর্মী, মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি, শিক্ষক-ছাত্র-যুব-নারী সমাজ, গণমাধ্যম কর্মী, চিকিৎসক-আইনজীবী-প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের ব্যক্তিরা অংশ গ্রহন করেন। অনশন কর্মসুচি চলাকালে গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পী ও কালায়ন চাকমার একক গণজাগরনী সংগীত পরিবেশনা ছাড়াও সজীব চাকমা ও মুন চাকমা কবিতা পাঠ করেন।
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান থেকে বিশিষ্ট আদিবাসী নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন স্তরের লোকজন সংহতি প্রকাশ করে অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন।
বিকালে অনশন কর্মসুচিতে ২৯৯নং সংসদীয় রাঙামাটি আসনের সাংসদ উষাতন তালুকদার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে অনশনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ানসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে পানি ও জুস খাওয়ায়ে অনশন ভঙ্গ করান।
প্রতীকী অনশন কর্মসূচিতে ৮ দফা দাবী উপস্থাপন করা হয়। সেগুলো হল পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে আইনী ও সংবিধিবদ্ধ ব্যবস্থা গ্রহণ,পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ ইত্যাদিসহ ৩৩টি বিষয় ও কার্যাবলী পূর্ণাঙ্গভাবে হস্তান্তর করা এবং এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচিত পূর্ণাঙ্গ পরিষদ গঠন,স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকা প্রণয়ন,পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন পূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা এবং অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিল করা,আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ করা ও তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন করা,‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার পূর্বক বেসামরিকীকরণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ,পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকুরীতে জুম্মসহ তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী অধিবাসীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ করা,চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ সংশোধন করা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ২৯৯ পার্বত্য রাঙামাটি আসনের সাংসদ ঊষাতন তালুকদার প্রধানমন্ত্রীর কাছে পার্বত্য চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে বলেন,পাহাড়ের আদিবাসী বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পার্বত্য চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য মিলিত হয়েছেন। তাই আর কুচক্রী আর গৃহপালিত চাটুকর বাহিনীর কথায় কান না দিয়ে চুক্তির যথাযথ এবং পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসুন।
সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন,পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ দেড় যুগ পরও চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয় তাহলে এর চেয়ে দুভার্গ্যরে বিষয় আর কিছ্ইু হতে পারে না। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ চুক্তি সম্পাদনের জন্য দেশে বিদেশ প্রশংসিত হয়েছেন। জাতি সংঘ কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছেন। তিনি পার্বত্য চুক্তি যত দ্রুত সম্ভব চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করে পার্বত্যবাসীর মুখে হাসি ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি বলেন, বাংলাদেশে যদি আদিবাসীদের অস্তিত্ব না থাকে তাহলে সংসদে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস কিভাবে এদেশে কার্যকর থাকে। চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে টালবাহানা করা সরকারের জন্য শুভ কোন ফল আনবে না।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মানিক লাল দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন প্রতিটি সচেতন মানুষের প্রাণের দাবি। এটি পার্বত্যবাসীদের অধিকারের দলিল। সকল মত, পথ আর বিভেদ ভুলে আমাদেরকে চুক্তির বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। আমাদের মধ্যে একতা থাকলে এমন কোন শক্তি নেই যা চুক্তি বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং গবেষক প্রফেসর মংসানু চৌধুরী বলেন, পার্বত্য চুক্তির ৮০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে এ দাবি করে সরকার পার্বত্যবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করছেন। পাশাপশি দেশে বিদেশে এ নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছেন। অথচ চুক্তির মৌলিক কতিপয় বিষয় যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ ইত্যাদিসহ ৩৩টি বিষয় ও কার্যাবলী পূর্ণাঙ্গভাবে হস্তান্তর, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকা প্রণয়ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন, আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ করা ও তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন করা ইত্যাদি এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন হলে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রত্যেকে যার যার অধিকার ভোগ সমানভাগে ভোগ করতে পারবেন। তিনি বলেন, মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন এর দাবির পাশপাশি এদেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে। যতদিন এই মানবাধিকার কমিশন এর কার্যকারিতা থাকবে প্রতিষ্ঠান হিসাবে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবির প্রতি কমিশনের অকুন্ঠু সমর্থন থাকবে।
নারী নেত্রী ডনাই প্রু নেলী বলেন, আদিবাসীরা এদেশের সন্তান। আদিবাসী পরিচয়েই আমরা এদেশে বাঁচতে এবং মরতে চাই। চুক্তি বাস্তবায়নে যত টালবাহানা করা হবে সরকারের প্রতি এখানকার জনগণ ততই আস্থা হারাবে। আর আদিবাসী মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গের অভিশাপ সইবার ক্ষমতা সরকারের নেই।
রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অরুন কান্তি চাকমা বলেন, চুক্তি স্বাক্ষরের পর দীর্ঘ ১৮ বছরে নানা অজুহাতে অনেক কালক্ষেপণ করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ধৈয্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে। মানুষ এখন রাস্তায় নামতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে সাধারণ জনগণকে নিয়ে রাজপথে আরো কঠোর আন্দোলন করতে বাধ্য হবে।
রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যবা মং মারমা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে বান্দরবান তথা বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে বনায়নের নামে ভূমি বেদখল, নতুন বসতি স্থাপন করা হচ্ছে। আর এখানকার আদিবাসীরা ক্রমশ তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.