জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান চিত্র যথাযথভাবে তুলে ধরতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন বলে দাবী করেছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।
জনসংহতি সমিতির দাবী, গত ১০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদেও অধিবেশনে ২৯৯নং পার্বত্য রাঙামাটি আসনের সাংসদ ঊষাতন তালুকদারের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে পূর্বের মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে বলে অসত্য বক্তব্য তুলে ধরেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অনেক ধারা বাস্তবায়ন না করেও তিনি তাঁর বক্তব্যে ‘সম্পূর্ণ’ বা ‘আংশিক’ বাস্তবায়নের দাবি করেছেন যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
মঙ্গলবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক প্রণতি বিকাশ চাকমার স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে একথা বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণের প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে এক খোলা চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকারের মধ্যকার একটি স্বার্থান্বেষী মহল অতি সুক্ষ্মভাবে ভুল ও মনগড়া তথ্য দিয়ে চলেছে। এমনকি তারা ভুলভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে পার্বত্য চুক্তিতে গৃহীত বিষয়গুলো ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার হীন উদ্দেশ্যে এই গোষ্ঠী অতি সুক্ষ্মভাবে সেই অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে একধরনের ভুল বুঝাবুঝি, বিভ্রান্তি ও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়াদিসহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো অবাস্তবায়িত রয়েছে। বিশেষ করে চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো পূর্বের মতো নিরাপত্তাহীন এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করছে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর এ গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় ভাষণে সেই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের এক দিক-নির্দেশনা থাকবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর উক্ত ভাষণে কেউই সেই দিক-নির্দেশনা বা আশার আলো খুঁজে পায়নি। তাঁর ভাষণে তিনি পূর্বের ন্যায় কেবল উন্নয়নের বিবরণই তুলে ধরেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে পূর্বের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যগুলো পুনরাবৃত্তি করেছেন। সর্বোপরি পূর্বের ন্যায় আবারও চুক্তি বাস্তবায়নে তাঁর সরকারের আন্তরিকতার কথা একইভাবে পুনর্ব্যক্ত করেছেন, যা শুনতে শুনতে মানুষ একদিকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ‘চুক্তির ফলে প্রায় সুদীর্ঘ ২২ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হয় উল্লেখ করে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বয়ে চলে শান্তির সুবাতাস’ বলে উল্লেখ করলেও চুক্তি স্বাক্ষরের পর স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর ছত্রছায়ায় জুম্মদের উপর সেটেলার বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখল, নারীর উপর সহিংসতা, সেনা নির্যাতন ইত্যাদি অব্যাহত রয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর জুম্মদের উপর সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক ১৮টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এসব হামলায় জড়িত কাউকেই বিচারের আওতায় আনা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের অগোচরে ও আলোচনা ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দাবী করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর গুইমারা উপজেলা, সাজেক থানা ও বড়থলি ইউনিয়ন গঠনের যে বিবরণ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে তুলে ধরেছেন সেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে আঞ্চলিক পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ করা হয়নি। সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, ঠেগামুখ স্থল বন্দর স্থাপন, স্থানীয় সেনা কর্তৃপক্ষ ও পর্যটন কর্পোরেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, রক্ষিত ও সংরক্ষিত বন ঘোষণা, বিজিবির বিওপি স্থাপন ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কার্যক্রম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ ছাড়াই গৃহীত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। পার্বত্যবাসীর বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রহরাধীনে নজীরবিহীনভাবে বিতর্কিত রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করার লক্ষ্যে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হলেও এভাবে এখনো পূর্বের মতো উপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার উন্নয়ন ধারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ রয়েছে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ‘চুক্তির অবাস্তবায়িত ধারাগুলোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সময়সূচি ভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ’ প্রসঙ্গে কোন কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেছেন। এমনকি তাঁর ভাষণে সময়সূচি ভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ না করার কারণ সম্পর্কেও তিনি কোন ব্যাখ্যা প্রদান করেননি। তার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের কোন কর্মপরিকল্পনা নেই বলে প্রমাণিত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে বর্তমানে জুম্ম জনগণের অসহযোগ আন্দোলন চলমান রয়েছে দাবী প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, জুম্ম জনগণ তাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও আবাসভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের স্বার্থে আত্মবলিদানে ভীত না হয়ে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বদ্ধপরিকর। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না করে সরকার যদি জুম্ম জনগণকে অধিকতর কঠোর আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়, তার ফলে উদ্ভূত যে কোন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী থাকবে বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ১ এপ্রিল ২০১৫ ২০১৫ সালের জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমার কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেশকৃত “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যেসব বিষয় বাস্তবায়িত হয়নি তার বিবরণ” শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো পরিচিহ্নিত করে বাস্তবায়ন যথাযথভাবে করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সময়সূচি ভিত্তিক কার্যকর কর্মসূচি ঘোষণা করা এবং আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক দৃঢ়তা নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.