বান্দরবান ও রাঙামাটিতে জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামীলীগ এবং প্রশাসনের ষড়যন্ত্র, দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক হয়রানির অভিযোগ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(জেএসএস)। আওয়ামীলীগের প্রত্যক্ষ মদদে এ পর্ষন্ত জেএসএস ও তার সহযোগী সংগঠনের ২ জন সদস্যকে হত্যা, ১৬ জনকে আটক, ৩০ জনকে আহত, কমপক্ষে ৫০ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের এবং শতাধিক নেতাকর্মী এলাকা ছাড়া হয়েছে বলে দাবী।
বৃহস্পতিবার জেএসএস’র কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো ইমেইল বার্তায় এ অভিযোগ করা হয়েছে।
জেএসএস’র পাঠানো বার্তায় অভিযোগ করা হয়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ আইন-শৃংখলা বাহিনীসহ স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় জেএসএস’র সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র, দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক হয়রানি চালিয়ে আসছে। নির্বাচন উত্তর সময়ে আওয়ামীলীগ ও প্রশাসনের সেই হীন তৎপরতা আরো জোরদার হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে কোন ঘটনা ঘটলেই তাতে জেএসএস নেতৃত্বকে জড়িত করে মিথ্যা মামলা দায়ের, গ্রেফতার, হয়রানি করা হচ্ছে। জনসভা, সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ জেএসএসকে নিশ্চিহ্নকরণ ও জেএসএস’র সদস্যদের জীবনহানি ও সম্পত্তি ধ্বংসের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে চলেছে। রাঙামাটিতে ইউপি নির্বাচন ঘোষণার পরপরই ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ রাঙামাটি জেলাধীন বিভিন্ন ইউনিয়নে সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে আওয়ামীলীগের অনেক প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিতে না পারার ষড়যন্ত্রমূলক ও ভিত্তিহীন অজুহাত তুলে ধরা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করা ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলাধীন ইউপি নির্বাচনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার হীন উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস বন্ধ এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের অজুহাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ গেল ২৪ মার্চ রাঙামাটি শহরে এক তথাকথিত সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশের আয়োজন করে। ফলে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর গেল ২৯ এপ্রিল রাঙামাটি জেলার ৪৯টি ইউনিয়নে নির্বাচন স্থগিত করা হয়।
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না করায় আওয়ামীলীগ তৃণমূল পর্যায়ে জনসমর্থন হারানো এবং তাদের নেতা-কর্মীরা তা বুঝতে পেরে দলীয় নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস না করায় অনেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী ছিলেন না।
ওই বাতায় আরো দাবী করা হয়, গেল ২১ মার্চ বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম গালেংগ্যা ইউনিয়ন পরিষদের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদ প্রার্থী ও জেএসএস’র সদস্য শান্তি ত্রিপুরাকে (৩৫) তার রামদুপাড়া গ্রাম থেকে অপহরণ করে আদিকা পাড়ার কাছে জঙ্গলে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দুর্বৃত্তরা তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। গেল ১৯ এপ্রিল রোয়াংছড়ি উপজেলার নোয়াপতং ইউনিয়নে আইন-শৃংখলা বাহিনী কানাইজো পাড়া ঘেরাও করে এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য পদপ্রার্থী থোয়াইচিংমং মারমা ও মংবুইশে মারমাকে আটক করে মারধর করে। এছাড়া থোয়াইচিংমং মারমার ৫ জন সমর্থককে আটক করে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এবং থোয়াইচিংমং মারমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করতে চাপ প্রদান করে।
পরে তাদেরকে সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করে আওয়ামীলীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী কর্তৃক জনসংহতি সমিতির সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে একটি সাজানো মামলা দায়ের করা হয়। গেল ২৩ এপ্রিল তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত বান্দরবানের ২৫টি ইউপি নির্বাচনে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে শত শত নকল ব্যালট পেপার ছাপিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ তাদের কর্মী ও সমর্থকদের সরবরাহ করে এবং ভোট প্রদানের সময় তারা সেসব নকল ব্যালট পেপারও ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়ে দিয়ে ব্যাপকভাবে ভোট জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাবৃন্দ কর্তৃক এসব নকল ব্যালট পেপারকে বৈধতা দিয়ে অধিকাংশ ইউনিয়নে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদপ্রার্থীদের অবৈধভাবে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।
গেল ২৫ এপ্রিল লামা উপজেলাধীন গজালিয়া বাজারে আওয়ামীলীগের লেলিয়ে দেয়া ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা জনসংহতি সমিতি ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সদস্য এবং গজালিয়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী চচিংমং মারমার পোলিং এজেন্টের উপর হামলা করে। এতে জনসংহতি সমিতির একজন ও পিসিপির দুইজন মোট তিনজন সদস্য গুরুতরভাবে আহত হয়। এছাড়া গেল ৩১ মে বান্দরবান জেলার কুহালং ইউনিয়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির কিবুক পাড়া শাখার তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুনীল চাকমাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকা-কে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা এবং তার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী বৈতরনী পার হওয়ার হীন উদ্দেশ্যে আওয়ামীলীগের যোগসাজশে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে যুব সমিতির তিনজন সদস্যসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে মেইগ্য মারমা নামে যুব সমিতির এক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
জেএসএস’র বার্তায় দাবী করা হয়. গেল ৪ জুন ২ ষষ্ঠ ধাপে অনুষ্ঠিত বরকল উপজেলাধীন ভূষণছড়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ছোট হরিণা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সহায়তায় কেন্দ্র দখল করে আওয়ামীলীগের দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী মামুনুর রশিদ মামুনের সমর্থকরা ব্যাপকভাবে জালভোট প্রদান করে। ভোট গ্রহণের সময় আওয়ামীলীগের দলীয় প্রার্থী মামুনুর রশিদ মামুনের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো একদল বহিরাগত ক্যাডার বিজিবি জওয়ানদের সহায়তায় ছোট হরিনা ভোট কেন্দ্র দখল করে ভূষণছড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী (আনারস প্রতীক) দীলিপ কুমার চাকমার পোলিং এজেন্টদের জোরপূর্বক কেন্দ্র থেকে বের করে দেয় এবং লাইনে দাঁড়ানো পাহাড়ি নারী-পুরুষ ভোটারসহ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের উপর এলোপাতাড়িভাবে হামলা করে।
এতে কমপক্ষে ১৯ জন পাহাড়ি ভোটার আহত হন। এ সময় প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারের নির্দেশে ভোটকেন্দ্রের ৬টি বুথ থেকে সকল ব্যালটবাক্স তুলে নিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষে জড়ো করা হয় এবং ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের সহায়তায় কয়েক ঘন্টা ধরে মামুনের ক্যাডাররা নৌকা প্রতীকের পক্ষে ব্যাপকভাবে জাল ভোট প্রদান করা হয়।
গেল ১৪ জুন ছোট হরিণা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পুন:নির্বাচনের দাবিতে সড়ক ও জলপথ অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে বিলাইছড়ি উপজেলা সদর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর ৪ কর্মীকে আটক করে আইন-শৃংখলা বাহিনী। জনগণের চাপের মুখে আটকের প্রায় দুই ঘন্টা পর পুলিশ ৩ জনকে ছেড়ে দিলেও সুনীতিময় চাকমা নামে পিসিপির এক সদস্যকে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়।
ওই বার্তায় আরো দাবী করা হয়, গেল ১৩ জুন বান্দরবান সদর উপজেলার রাজভিলা ইউনিয়নের জামছড়ি মুখ গ্রামের অধিবাসী ও আওয়ামীলীগের সদস্য মংপু মারমাকে কে বা কারা অপহরণ করে। এ অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইন-শৃংখলা বাহিনীর যোগসাজশে স্থানীয় আওয়ামীলীগ জেএসএস, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও যুব সমিতির নেতাকর্মী ও নিরীহ গ্রামবাসীর ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১৫ থেকে ২০ জনের বিরুদ্ধে গণহারে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। এতে জেএসএস’র বান্দরবান সদর থানা কমিটির সভাপতি উচসিং মারমাসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুদিন পর এক জনকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় অপহৃতকে উদ্ধারের নামে ও আসামীদের গ্রেফতারের নামে রাজভিলা, কুহালং, নোয়াপতং, বান্দরবান সদরে আওয়ামীলীগ কর্মীদের নিয়ে আইন-শৃংখরা বাহিনী নিয়মিত তল্লাশী অভিযান চালিয়ে আসছে। এতে করে এলাকায় এক নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং হয়রানির শিকার জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। জেএসএস’র ও তার সহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মী মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার ও হয়রানি এড়ানোর জন্য এলাকা ছাড়া হতে বাধ্য হয়েছে।
এ অপহরণ ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের সামনে ‘কেএস মং মারমাসহ জেএসএস নেতৃবৃন্দকে ছাড় দেয়া হবে না’ বলে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী ও এমপি বীর বাহাদুর উশৈসিংও প্রকাশ্যে হুমকি প্রদান করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিন্ত্রীর মর্যাদায় দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে বীর বাহাদুরের এধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অপরিনামদর্শী বক্তব্য কখনোই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না।
প্রেস বার্তায় দাবী করা হয়, জেএসএস ও তার সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও প্রশাসনের ষড়যন্ত্র, ফ্যাসীবাদী দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক হয়রানির মূল উদ্দেশ্যই হলো বর্তমান সরকার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না করায় ক্ষমতাসীন দলের প্রতি জনমানুষের ক্ষোভ এবং অসন্তোষকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা। এভাবে সরকারি মহলের ফ্যাসীবাদী তৎপরতা চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরো জটিল থেকে জটিলতর হতে বাধ্য। তার ফলে যে কোন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির জন্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের জেলা সভপতি ক্যশৈহ্লা সহ আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃত্ব ও প্রশাসনই দায়ী থাকবে, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না বলে ওই বার্তায় হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।
প্রেস বার্তায়,অচিরেই জেএসএস ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ষড়যন্ত্র, ফ্যাসীবাদী দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক হয়রানি বন্ধ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে সাজানো ও ভিত্তিহীন মামলা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করার দাবী জানানো হয়েছে। মংপু মারমাকে অপহরণের ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে তাকে উদ্ধারের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। পাশাপাশি বান্দরবানের আওয়ামীলীগ যে সংকটজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তা দ্রুত নিরসনের জন্য কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে প্রেস বার্তায়।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.