আজ ১০ নভেম্বর, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম সাংসদ শহীদ মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার(এমএন লারমা) ৩২তম মৃত্যূ বার্ষিকী। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর জনসংহতি সমিতির বিভেদপন্থী গ্রুপের বিশ্বাসঘাতকতামূলক সশস্ত্র হামলায় তিনি ৮জন সহযোদ্ধাসহ খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির গভীর জঙ্গলের এক গোপন আস্তানায় নির্মমভাবে শাহদাৎ বরণ করেন।
এদিকে আজ মঙ্গলবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি ও তার অঙ্গ সংগঠনের পক্ষ থেকে তিন পার্বত্য জেলায় এমএন লারমার ৩২ তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহন করেছে।
এমএন লারমা ১৯৩৯ সারে ১৫ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মহাপ্রুম নামক স্থানে(বর্তমানে কাপ্তাই বাধেঁর কারণে বিলুপ্ত) জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা চিত্ত কিশোর লারমা, মাতা শুভাষিনী দেওয়ান। এমএন লারমার তিন ভাই ও এক বোন। সবার বড় জ্যোতি প্রভা লারমা(মিনু) ছিলেন একজন সমাজকর্মী। বড় ভাই শুভেন্দু লারমা(বুলু) ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী, দক্ষ সংগঠক ও বিপ্লবী। তিনিও ৮৩’ সালের ১০ নভেম্বর সেই কালো রাত্রিতে এমএন লারমা সঙ্গে শহীদ হন। সব চেয়ে ছোট ভাই বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা)।
শহীদ এমএন লারমা ১৯৫৮ সালে রাঙামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক(আইএ) পাস এবং একই কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি এলএলবি পাশ করে তিনি চট্টগ্রাম বার কাউন্সিলে যোগদান করেন। ১৮ জুন তিনি পার্বত্য ছাত্র সমিতি নামে একটি সংগঠন গঠন করেন এবং সর্ব প্রথম পাহাড়ি ছাত্র সন্মেলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন।
১৯৬০ সাল আদিবাসী জনগণের জন্য এলো এক বিভাষিকাময় বছর। সে সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কাপ্তাই জল বিদ্যূৎ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৩ সালে ১৫ ফের্রুয়ারী রাষ্ট্রদ্রোহিতা অভিযোগ এনে তাঁকে গ্রেফতার করে এবং প্রায় দু বছর জেলে রাখার পর ১৯৬৫ সালে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
উল্লেখ্য, কাপ্তাই বাধেঁর কারণে ৪০ হাজারের অধিক একরের উর্বর ধান্য জমি জলমগ্ন হয় এবং এক লাখ আদিবাসী জনগন উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার অসন্তোষের কারণে আদিবাসী জনগণের বিদ্রোহী মনোভাবের জন্ম নেয়।
১৯৭০ সালে এমএন লারমা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন এবং একই বছর পাকিস্তান প্রদেশিক পরিষদে বিপুল ভোটে সাংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে ১৫ ফের্রুয়ারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয় এবং তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। পরে তিনি জনসংহতি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে বিপুল ভোটে জয়ী হন। ১৯৭৪ সালে পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তিনি লন্ডন সফর করেন। আদিবাসী জনগনের আতœনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রথম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তৎকালীন সময়ে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে আতœগোপণ করেন এমএন লারমা এবং তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী জনগণের আত্ননিয়ন্ত্রনাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সামরিক উইনিং ‘শান্তিবাহিনী, নামে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭৬ সালের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রমে ‘শান্তিবাহিনীর, সামরিক তৎপরতা শুরু হয়। সামরিক তৎপরতা দ্রুত সম্প্রসারিত হয়ে যা ১৯৮০ সালের দিকে বেশী জোরালো হয়ে উঠে।
এর পর ১৯৮২ সালে ২৪ জুন জনসংহতি সমিতির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এ সন্মেলনের পর আদর্শগত ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে জনসংহতি সমিতি শেষ পর্ষন্ত দ্বিধাবিভক্ত ঘটে এবং ১৯৮৩ সালের ১৪ জুন সর্ব প্রথম লারমা গ্রুপ (লম্বা)ও প্রীতি গ্রুপ(বাদি) পরস্পর সশস্ত্র গৃহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ১৯৮৩ সালে ১০ নভেম্বর বিভেদপন্থী প্রীতি গ্র“পের সদস্যরা হামলা চালিয়ে এই সংগ্রামী মহান নেতা এমএন লারমাকে তার আটজন সহযোগীসহ নির্মমভাবে হত্যা করে। তার সঙ্গে আরও ৮ জন সহযোদ্ধা নিহত হন। এ মহান নেতা মৃত্যুর আগ পর্ষন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের দশ ভাষাভাষি ১৪টি আদিবাসী জাতিসত্বাদের আত্ননিয়ন্ত্রনাধিকার আদায়ের সংগ্রাম করে গেছেন।
এমএন লারমার মৃত্যূ হলে তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু) একনিষ্ঠ দক্ষতা, বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির আরও বেশী সক্রিয় হয়ে উঠে। তৃতীয় কংগ্রেস সন্মেলনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(শান্তিবাহিনী) আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠলে ১৯৮৬ ও ৮৯ সাল পর্ষন্ত নব উদ্দীপনায় সংগ্রাম চালালে বাংলাদেশ সরকার জনসংহতি সমিতির সাথে শান্তির বৈঠকে বসতে রাজি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালের ২ডিসেম্বর জনসংহতি সমিতির সাথে বাংলাদেশ সরকার এক ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চূক্তি, নামের এক চুক্তি সম্পাদন সম্পন্ন করে।
এদিকে, আজ মঙ্গলবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি ও তার অঙ্গ সংগঠনের পক্ষ থেকে এমএন লারমার ৩২ তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহন করেছে। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করুন, চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থপরিপন্থী সকল কার্যক্রম প্রতিরেধ করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে চলমান অসহযোগ আন্দোলনকে জোরদার করুন-এ শ্লোগানকে সামনে রেখে সোমবার সকালের দিকে রাঙামাটি শহরে প্রভাবফেরী, শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদ বেদীতে পুষ্পমাল্য অপর্ণ, স্মরণ সভা এবং বিকালে প্রদীপ প্রজ্জ্বল ও ফানুস বাতি উড়ানো। এএমএন লারমার ৩২ তম মৃত্য বার্ষিকী রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন ছাড়াও অপর দুই জেলা বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে দিবসটি পালনের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.