আজ আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবস। সারা বিশ্বের আদিবাসী জনগণের ন্যায় বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সম্প্রদায়ও এ দিবসটি নানান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করছে। এবারের আদিবাসী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে “আদিবাসীদের শিক্ষা, ভূমি ও জীবনের অধিকার”।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রতিবছর ৯ আগষ্টকে আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষনা দেয়। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী আদিবাসী বিষয়টি জোরালোভাবে মনোযোগ আকর্ষনের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং মানবধিকার, পরিবেশ, উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আদিবাসী জনগনের সমস্যা সমাধানের জন্য আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে প্রথমে ১৯৯৫-২০০৪ সালের সময়কে প্রথম আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দশক ঘোষনা করে।
পরবর্তীতে ২০০৫-১৪ সালের সময়কে দ্বিতীয় আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষনা করে জাতিসংঘ। এছাড়া জাতিসংঘ ২০০০ সালে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম গঠন করে। ২০০১ সাল থেকে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক স্পেশাল র্যাপেটিয়ার নিয়োগ এবং ২০০৭ সালে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষনাপত্র গ্রহন ও আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কর্মব্যবস্থা প্রবর্তন, ২০১৪ সালে সাধারণ পরিষদের বিশ্ব আদিবাসী সম্মেলন আয়োজন এবং এ সম্মেলনে ঐতিহাসিক ‘আউটকাম ডকুমেন্ট’ গ্রহণ করে।
বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে আইএলও’র আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী কনভেনশন নং ১০৭ অনুস্বাক্ষর করলেও উক্ত কনভেনশনে স্বীকৃত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের প্রথাগত ভূমি অধিকার তথা ভূমির উপর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকার, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ লাভ, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি, সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি অধিকার বাস্তবায়নে সরকার এগিয়ে আসেনি। উপরন্তু সরকার ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধমে আদিবাসী হিসেবে পরিচিতির স্বীকৃতি লাভের দাবিকে উপেক্ষা করে ‘ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ পরিচয়ে অখ্যায়িত করে।
এতে পাহাড় ও সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিরোধিতাও করা হয়। তাই এই দিবসটি উৎসবের আমেজে হওয়ার কথা থাকলেও প্রতিবছর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা ক্ষোভ ও হতাশার মধ্য দিয়ে উদযাপন করে থাকেন।
জানা যায়,পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ৫৪টি অধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। এসব জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যার পরিমাণ প্রায় ৩০ লাখ। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস রয়েছে ১৪টি সম্প্রদায়। যার জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ৮ লাখ। তাদের রয়েছে স্বকীয় স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি,ইতিহাস,ঐতিহ্য, কৃষ্টি. পোশাক, খাদ্যাভাস, জীবনধারা, রীতি-রেওয়াজ ও ধর্ম। এছাড়া দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য,সংস্কৃতি, রাজনীতি তথা সভ্যতা বিনির্মাণে এ জাতিসত্বাদের অপরিসীম অবদান রয়েছে। তবে স্বাধীনতার স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও দেশের সংবিধানে এই জাতিসত্বাদের আত্ব -পরিচয় এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন দৃষ্টিভঙ্গি বিকশিত হতে পারেনি।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ আদিবাসীদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিলেও শিক্ষা নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশুদের স্ব-স্ব মাতৃভাষায় পাঠদান কর্মসূচি চালুর লক্ষে সরকার ২০১২ সালে প্রথম দফায় ৫টি ভাষায় মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরে পাঠ্য পুস্তক প্রনয়ন ও পাঠদানের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ২০১৬ সালেও এ কার্যক্রম শুরু হয়নি।
এদিকে, দীর্ঘ দুদশক ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিও উন্নয়নে এবং সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু চুক্তির ১৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনসহ পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। তবে গত ১ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রীসভার নিয়মিত বৈঠকে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন(সংশোধন) আইন ২০১৬ এর খসড়ার নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে এ আইনটিতে ২৩টি সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়। দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে ১৪টি সংশোধনী অনুমোদন করে মন্ত্রী সভা। ভেটিং শেষে মন্ত্রী সভায় চুড়ান্ত অনুমোদনের পর আইনটি সংসদে যাবে। তবে সংসদ যেহেতু দুই মাস পরে বসবে তাই জরুরী বিবেচনায় অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে। ২০০১ সালের ২০ জুনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন তিন বছর মেয়াদে এ পর্ষন্ত পাঁচটি কমিশন গঠন করা হলেও দীর্ঘ ১৮ বছরেও ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতি হয়নি।
সাংবিধানিক স্বীকৃতি উপেক্ষিত থাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, নারীর উপর ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ নৃশংস সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে কাপেং ফাউন্ডেশনের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ২০১৫ সালে ১৫ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে হত্যা করা হয়েছে। ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ৮৪টি বাড়ি-ঘর ধ্বংস ও ৩৫ বাড়িতে ভাংচুর ও লুটতরাজ চালায়। কমপক্ষে ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার উচ্ছেদের শিকার হয়। তাছাড়া ১,৪০০ পরিবার উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে রয়েছে। ২০১৫ সালে ৮৫ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ৪টি বৌদ্ধ মন্দির এবং সমতলের একটি হিন্দু মন্দিরে লুটপাট ও ভাংচুর চালানো হয়। ২০১৫ সালে সারাদেশে ৮৫ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী ও কন্যাশিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। চলতি বছরে জুন পর্যন্ত ২৯ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও শিশু যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য অঞ্চল শাখার সদস্য সচিব ইন্টু মনি তালুকদার বলেন, “আদিবাসীদের স্বীকৃতির দাবিতে আদিবাসী ফোরাম কাজ করে যাচ্ছে। তিনি অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন ও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানান।”
চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেন, “আদিবাসীরা যেভাবে পরিচয় হতে চায় সেভাবে সংবিধানে আসেনি। তবে সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি, জাতিসত্বা ইত্যাদি শব্দ নিয়ে আদিবাসীদের কথা বলা হয়েছে। এ শব্দগুলো যথাযথ না, কিন্তু স্পিরিটটা ঠিক রয়েছে।”
“দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া গেলেও সরকার দিতে চাচ্ছে না বলে মন্তব্য তিনি আরো বলেন, সংবিধানে আদিবাসী শব্দটি থাকুন না থাকুক, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওয়াগাছড়া মামলায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ মর্যাদায় সংবিধানে প্রত্যক্ষভাবে লেখা না থাকলেও সংবিধানের বিশেষ আওতায় বিশেষ মর্যাদায় আসে। সুতরাং ইন্ডেজিনাস শব্দটি সুপ্রিম কোর্ট মেনে নিয়েছে। কিন্ত সরকার এখনো মেনে নেয়নি।”
২৯৯নং রাঙামাটি আসনের সাংসদ উষাতন তালুকদার বলেন, “সারা বিশ্বে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের অধিকার চিহিৃত করা হয়েছে। তবে দুঃখজনক আমাদের সরকার এখনো পর্ষন্ত আদিবাসী বিষয়টিকে গ্রহন করতে পারেনি। যার কারণে অনুষ্ঠানিকভাবে সরকারী উদ্যোগে আদিবাসী দিবসটি পালন করার কথা কিন্তু তা পালিত হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “অনেকে মনে করে থাকেন আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে তাদের অধিকার দিতে হবে। আবার অনেকে মনে করে থাকেন আদিবাসীরা আদি না। আবার পার্বত্য চট্টগ্রাম বেলায় কেউ কেউ বলে থাকেন এখানে আদিবাসীরা আগে এসেছে নাকি বাঙালীরা আগে এসেছে। আসলে আদিবাসী শব্দটি আদি অর্থে ব্যবহৃত নয়।
এখানে আদিবাসী বলতে যাদের সংবিধানিক অধিকার ও মানবধিকার নেই, যারা শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে,যাদের জাতীয় পলিসি লেভেলে প্রতিনিধিত্ব ও শাসতান্ত্রিক অংশিদারিত্ব নেই, যারা নিজেদের সামাজিক বিচার-আচার করে থাকে সেই সমস্ত জনগোষ্ঠীকে বিশ্ব ব্যাপী একটা সংজ্ঞা নিরুপণ করা হয়েছে যে তারা আদিবাসী। সেই আঙ্গিকে এ দেশে যারা অধিকার বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদেরকে আদিবাসী বলা যাবে।”
দিবসটি উপলক্ষে কর্মসূচিঃ আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ, র্যালী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠান উদ্ধোধন করবেন এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল এবং প্রধান অতিথি থাকবেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন,এমপি। সভাপতি সভাপতিত্ব করবেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা(সন্তু লারমা)।
এদিকে, রাঙামাটিতে দিবসটি উপলক্ষে রাঙামাটি পৌর প্রাঙ্গনে আলোচনা সভা ও র্যালীর আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের উদ্ধোধন করবেন চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় এবং প্রধান অতিথি থাকবেন ২৯৯নং রাঙামাটি আসনের সাংসদ উষাতন তালুকদার।
এছাড়াও রাজশাহী, দিনাজপুর, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, শেরপুর, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কক্সবাজার প্রভৃতি স্থানে আদিবাসী দিবস উদযাপন করা হবে বলে জানা গেছে।
--হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর.